বিশেষ সাক্ষাৎকার
বেগম রোকেয়া পদক ও নারীর অগ্রযাত্রা
ঢাকাপ্রকাশের স্টুডিওতে ডা. সারিয়া সুলতানা
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মদিনে পালন করা হয় বেগম রোকেয়া দিবস। এদিন নারীর উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদের বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।
২০২১ সালে অন্যান্যদের মধ্যে বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন কুষ্টিয়া জেলার গবেষক ড. সারিয়া সুলতানা। পুরস্কার গ্রহণের পরে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকাপ্রকাশের স্টুডিওতে। সমাজে নারীর বর্তমান অবস্থান নিয়ে ঢাকাপ্রকাশের সারা জেরিন তাসপিয়া কথা বলেছেন এই গবেষকের সঙ্গে।
-আপনাকে অভিনন্দন। সম্প্রতি আপনি বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত হয়েছেন, এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাচ্ছি–
-বেগম রোকেয়া পদক একটি রাষ্ট্রীয় পদক এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কমিটির আহ্বায়ক। এ পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ খুবই বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি ছাড়া আরও যে চারজন এ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই এ পদক পাওয়ার যোগ্যতা রাখে এবং এদেশের নারী উন্নয়নে অনেক কাজ করে যাচ্ছেন তারা। সম্ভবত আমি সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে পদকটি পেয়েছি। আমার বয়স ৪০-এর কোটায়। এ বয়সে এমন একটি পদক পাব কখনও ভাবিনি। আমি খুবই আনন্দিত। প্রথমে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই, আমার মতো একজন গবেষককে পল্লী উন্নয়নে মনোনয়ন দিয়েছেন বলে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রাণালয়ের যারা এ কমিটিতে আছেন তাদেরও আমি ধন্যবাদ জানাতে চাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি কারণ পল্লী উন্নয়নে আমার গবেষণা যথাযথ মূল্যায়ন পেয়েছে। এ পদক গ্রহণ করে আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল।
-পল্লী উন্নয়নে আপনার ব্যাপক গবেষণা ও তৎপরতা রয়েছে । এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন–
আমার গবেষনার বিষয় 'Role of Link Model on sustainable rural development in Bangladesh.' আমি গবেষণা করছি, কীভাবে ইউনিয়ন পরিষদকে আরও শক্তিশালী করে পল্লী উন্নয়ন করা সম্ভব লিংক মডেল পদ্ধতির মাধ্যমে। ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন ছাড়া কখনওই পল্লীকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয় এবং পল্লীর জনগনের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। তবে সেটি যদি একটি পদ্ধতির মাধ্যমে করা যায় তবে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ বাড়বে। এর ফলে টেকসই পল্লী উন্নয়ন হবে। এ ক্ষেত্রে লিংক মডেল পদ্ধতিটি খুবই কার্যকর। যেমন- ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকবেন সভাপতি। প্রতিটি গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদে জাতি গঠনের জন্য যে ১৬টি ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধিরা কাজ করে, এ প্রতিনিধিরা প্রতি মাসে ইউনিয়ন সমন্বয়ে মিটিং করবেন। সেখানে প্রত্যেক গ্রামের প্রতিনিধি থাকবেন এবং এখানে চেয়ারম্যান সভাপতি থাকবেন ও ইউনিয়ন পরিষদের সকল সদস্য উপস্থিত থাকবেন। সেখানে একধরনের মিনি পার্লামেন্ট সৃষ্টি হবে। তখন তারা গ্রামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন এবং এখানে সবাই তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য হবে। এর ফলে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা সৃষ্টি হবে।
-পল্লী উন্নয়নে নারীর ভূমিকা কী?
-পুরুষ-নারী উভয়ের অবদান রয়েছে। তবে বর্তমানে পল্লী উন্নয়নে নারীরা যথেষ্ট কাজ করছে। আমি ফিল্ড ওয়ার্ক করতে গিয়ে দেখেছি পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমান তালে কাজ করার চেষ্টা করছে। একসময় নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল না। এখন নারী সে সুযোগটি পাচ্ছে এবং গ্রাম ইউনিয়নের মিটিং-এ এক তৃতীয়াংশ নারী অংশগ্রহণ করছে। তাদের প্রিতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। পল্লী উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন লক্ষ্যণীয়। টেকসই পল্লী উন্নয়নের এইচডিজি-এর ৫ নম্বর লক্ষ্যের একটি অংশ women empowerment। নারীরা পল্লী উন্নয়নে অবশ্যই অবদান রাখছে, আশা করছি আরও অবদান রাখবে।
-আমাদের দেশে নারীরা কি তাদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে?
-নারীরা বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার। আমরা নারীরা নারীদের দ্বারাও নির্যাতিত। একটি কর্মস্থলে একজন নারী আরেকজন নারীর সফলতা দেখতে পারছেন না। এ ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনও নারীরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পায়নি, সেটি না পরিবারে আর না কর্মস্থলে। নারীর পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দরকার, যেটি শুধু পল্লী উন্নয়ন নয়, রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
-নারীর ক্ষমতায়ন করতে আমাদের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন?
-আমার মনে হয় সবার আগে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। মানুষের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া কখনও উন্নয়ন সম্ভব না। উন্নয়নের প্রথম শর্ত হচ্ছে মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন। আমাদের ‘আমি’ চিন্তা না করে সামষ্টিকভাবে ‘আমাদের’ চিন্তা করতে হবে।
-গ্রামীণ নারীসমাজ এখনও অবহেলিত। তাদের উত্তরণের জন্য আমাদের কী করণীয়?
-প্রথমেই নারীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। নারীশিক্ষায় সরকার অনেক ব্যয় করছে এবং বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। শিক্ষা গ্রহণের পথটি আমাদের জন্য এখন সহজ। তাছাড়া বাল্যবিবাহ রোধে আমাদের সকলের সতর্ক হতে হবে। সরকারের একার পক্ষে সকল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের সকলের সমষ্টিগত সহযোগিতা এবং সচেতনতা প্রয়োজন।
-নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন?
-নারীদের নিজেদের স্পৃহা প্রয়োজন। আমার নিজের স্পৃহা না থাকলে কেউ আমাকে তুলে ধরবে না। অন্যরা অনুপ্রেরণা দিয়ে সাহায্য করবে তবে নারীর নিজেকে নিজের তুলে ধরতে হবে। অবশ্যই নিজের চেষ্টা থাকতে হবে। করোনাকালীন এ প্রতিকূলতার মধ্যেও অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়টি খুবই ভালো লেগেছে। নারীরা এখন বুঝতে পারছে এবং তারা স্বাবলম্বী হচ্ছে। প্রতিটি কাজেরই বাধা থাকবে তবে বাধা পেরিয়েই নারীকে এগিয়ে যেতে হবে।