সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে নির্মাণ সামগ্রীর দাম
দুই সপ্তাহ আগেও রহিম স্টিল রডের দাম ছিলো ৭৯ হাজার টাকা টন। এখন তা ৯০ হাজার টাকা টন ছাড়িয়েছে। আবার টাকা দিয়েও সময় মতো পাওয়া যাচ্ছে না। একই দশা সিমেন্টের। প্রতি বস্তা নির্দিষ্ট কোম্পানির সিমেন্ট আগে ৪১০ টাকায় পাওয়া যেত। বর্তমানে তা ৫০০ টাকা। ইটের দামও হাজারে বেড়েছে দুই হাজার টাকা। নির্মাণ খাতের প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে কাজ বন্ধ রেখেছে বেশিরভাগ আসাবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। আর যারা নিজেরা মাথা গোঁজার ঠায় নির্মাণ করছেন, তারা পড়েছেন বিপাকে।
আবাসন প্রতিষ্ঠান এসডি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ জালাল বলেন, ‘আগের রেটে কাজ ধরেছি, কিন্তু ইট, রড, সিমেন্টের দাম বেড়েছে। ফলে জায়গা জমি বিক্রি করতে প্রজেক্ট শেষ করতে হবে।
শুধু তিনিই নন, অনেক নামি-দামি বড় বড় ডেভলপার কোম্পনিও তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে নির্মাণ ব্যয়। এভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাইতো স্থবির হয়ে গেছে আবাসন খাত।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেছেন, করোনার আগে থেকেই কাঁচামাল সংকট চলছে। যে কারণে রডের দাম আকাশছোঁয়া। ইউক্রেন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামালের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আর কয়লার দামও লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। ৭ হাজার টাকা টনের কয়লা ২৫ হাজার টাকা হয়েছে। তাই ইটের দামও হুহু করে বাড়ছে।
জানতে চাইলে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের সেমার্স একতা ব্রিকসের জাহাঙ্গীর আলম ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘ ইটের গাড়ি ৩৫ হাজার টাকা মানে প্রায় ১২ হাজার টাকা প্রতি হাজার ইটের দাম। আরও বাড়বে দাম। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু কয়লার দাম কমছে না। তাই ইটের দামও বাড়বে। কোথায় ঠেকবে তা বলা মুশকিল। কারণ গত বছরে এক নম্বর ও পিক ইট ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়েছে।’
শুধু রড, সিমেন্ট ও ইটের দামই নয়, নির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে হার্ডওয়ারী থেকে শুরু করে থাই গ্লাস, সিরামিক, টাইসের দামও বাড়ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। মোহাম্মদপুরের মেসার্স আয়েশা হার্ডওয়ারের মালিক শরীফ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘মূল্যছাড় দিয়ে বার্জার পেইন্টের সিলার আগে ৩ হাজার টাকা ড্রাম বিক্রি করেছি। আর ওয়াল পুটিং ১ হাজার ৫০০ টাকা ড্রাম। কিন্তু আজ থেকে কোম্পানির সুর পাল্টে গেছে। ড্রামে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। এভাবে অন্যান্য হার্ডওয়ারের দামও বাড়তি।
এদিকে ফার্মগেটের শাহ আলম ট্রেডার্সের শাহ আলমও বলেন, ‘থাই গ্লাসের খুব খারাপ অবস্থা। সবমিলে আগে ৩২০ টাকা বর্গফুট বিক্রি করা হলেও বর্তমানে ৫০০ টাকার নিচে পাওয়া কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে আরও বাড়বে দাম।’
মোহাম্মদপুরের মদিনা করপোরেশনের মেহেদী হাসান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘মিল থেকে সহজে রড পাওয়া যায় না রড, সিমেন্ট। প্রতিনিয়ত বাড়ছে দাম। প্রায় একমাস ধরে ৬০ গ্রেডের রড ৮০ হাজার টাকা ছিলো। বর্তমানে তা ৯০ হাজার টাকার বেশি। বিএসআরএম ও রহিম স্টিলের রড ৯০ হাজার ৫০০ টাকা এবং একেএস রড টনপ্রতি ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাও আবার অর্ডার দিলে সহজে পাওয়া যায় না। আর ৪১০ টাকার সিমেন্ট বর্তমানে ৫০০ টাকারও বেশি। এক মাস আগে ৪২০ টাকা প্যাকেট বিক্রি করা হলেও বর্তমানে সুপারক্রিট ৫১০ টাকা, স্ক্যান সিমেন্ট ৫২৫ টাকা, ফ্রেশ ৪৮০ টাকা প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে। মেঘনাসহ অন্যান্য সিমেন্টও এভাবে বাড়তি দামে কেনার কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
ঢাকা স্টিলের রিয়াদ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আগে সপ্তাহে ২৫ থেকে ৪০ টন রড বিক্রি করা হতো। বিক্রি কমতে কমতে এখন এক টনে নেমে এসেছে।
মোহাম্মদপুরের অপর এক রড সিমেন্টের বিক্রেতা জানান, ক্রেতারা রড না পেয়ে বাড়ি-ঘর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। মিলমালিকরা রড দেয় না। ফলে আমরাও চাহিদা মোতাবেক ক্রেতাদের রড সরবরাহ করতে পারছি না।
মিলমালিকদের মতে, দেশে বার্ষিক রডের চাহিদা ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন। এর মধ্যে সরকারি উন্নয়নকাজে ব্যবহার হয় ৬০শতাংশ। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ বেসরকারি খাতে। সম্প্রতি হুহু করে রডের দাম বাড়তে থাকায় সরকারি বেসরকারি সব খাতই স্থবির হয়ে গেছে।
এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকেও বলা হয়েছে বর্তমানে ৬০ গ্রেড রডের দাম বেড়েছে।
রডের প্রধান কাঁচামাল পুরোনো লোহালক্কড় বা আমদানি স্ক্র্যাপ। এসব দিয়ে রি-রোলিং মিলে গলিয়ে রড তৈরি করা হয়। ৩০ শতাংশ স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করা হয় অভ্যন্তরীণভাবে। ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী ও পুরাতন জাহাজ কেটে তা থেকে স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করা হয়। আর বাকি ৭০ শতাংশ স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়।
চট্রগ্রাম থেকে নারায়নগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএসআরএম, একেএস, রহিম স্টিলসহ রি-রোলিং মিলের সংখ্যা ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩০টি। এরমধ্যে বড় আকারের ৫০টি। বাকিগুলো ছোট ও মাঝারি।
উল্লেখ্য, রডের প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয় মূলত ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে। ইউরোপের দেশ ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সাম্প্রতিক হামলার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম আরও বেড়ে যায়।
রি-রোলিং মিলের মালিকরা বলেছেন, যুদ্ধের আগে বিশ্ববাজারে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৫৭০ থেকে ৬০০ ডলার। সেই স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে এখন ৬৫০ থেকে ৭০০ ডলার। হঠাৎ মূল্য বৃদ্ধির কারণে স্ক্র্যাপ সরবরাহ ব্যহত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় বাজারে।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং মিলস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সভাপতি ও শাহরিয়ার স্টিল মিলের মালিক মাসাদুল আলম মাসুদ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে দাম বাড়ছে কিছু বলার নেই। কারণ রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল পুরোনো লোহা, যা স্ক্র্যাপ নামে পরিচিত। এই স্ক্র্যাপ আমদানি করে আমরা কারখানায় বিলেট তৈরি করে রড উৎপাদন করি। কিন্তু এই কাঁচামাল নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। বেশির ভাগ ফ্যাক্টরি কাঁচামাল সংকটে ভুগছে, যে কারণে রডের সংকট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে মিলমালিকদের কাছে কোনো স্টক নেই। ফলে নিয়মিত এলসি খুলে কাঁচামাল আনতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান নগদ অর্থসংকটে ভুগছে। ফলে তারা এলসি খুলতে পারছে না।
কিভাবে কমতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অস্থির রডের বাজার সহনীয় করতে হলে এর কাঁচামাল স্ক্র্যাপ সহজলভ্য করতে হবে। এ জন্য কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর রেয়াত দেয়ার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচামালের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তা না হলে বাড়তে থাকবে রডের দাম। এর প্রভাব পড়বে আবাসন নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে সাবেক সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘কিছু দিন আগে থেকে বাড়তেই আছে নির্মাণ সামগ্রীর দাম। এরফলে আবাসন খাতে ধস নেমে গেছে। এছাড়া পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ সরকারের উন্নয়ন কাজেও প্রভাব পড়েছে। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিৎ অতি দ্রুত সভা করে করণীয় নির্ধারণ করা। কারণ এভাবে সব জিনিসের দাম বাড়তে থাকলে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।’ অনেক কোম্পানি গ্রাহককে ফ্লাট বুঝিয়ে দিচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা এ কাজ করছে ঠিক করছে না। কারো অভিযোগ থাকলে আর্বিটেশন বোর্ড রয়েছে। সেখানে অভিযোগ করলে তা আমলে নেওয়া হবে।’
জেডএ/