আপনি কি জানেন, আত্মহত্যার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ?
আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনাকারীকে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর শাস্তি, দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় এক বছরের কারাদণ্ড। এরপরও মানুষ নিজেকে নিজে হত্যার মতো সিদ্ধান্ত নেয় কেন? এমন নানান প্রশ্ন অনেকের মনেই দেখা দেয়।
গত মাসের ২ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডের একটি বাড়ির লেভেল-৫ এর একটি ফ্ল্যাটে নিজে বন্দুক মাথায় ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান। আত্মহত্যার আগে তিনি চিরকুটে সবকিছু লিখে গেছেন। ব্যক্তিগত নানা হতাশার কারণে তিনি এ পথ বেছে নিয়েছেন। এরপর সারাদেশে এ বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। চোখের সামনে এমন একটি প্রাণ ঝরে পড়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকেই।
চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দুপুরে প্রেস ক্লাবের সামনে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেন এক যুবক। ওই যুবকের নাম মামুন মিয়া (২৭)। আগুন দেওয়ার সময় সে বলে, ‘সবাই সরে যান। আমি গায়ে আগুন দেব।’ তখন উপস্থিত লোকজন ও পুলিশ সদস্যরা কিছু সময় চেষ্টা করে যুবকটিকে উদ্ধার করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যান। এ ঘটনায় মামুনের বিরুদ্ধে ৩০৯ ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শ্রী চম্পক চক্রবর্তী বলেন, সাধারণ আত্মহত্যায় চেষ্টা বা প্ররোচনা করলে ৩০৯ ও ৩০৬ ধারায় মামলা হয়। মামুনের বিরুদ্ধে সেটি হয়েছে।
এদিকে পুলিশ বলছে, আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। তবে মরার পরে অপমৃত্যু মামলা হয়। আইনে আত্মহননের চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া আরও বড় অপরাধ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ হেডকোয়ারটার্সের এক কর্মকর্তা বলেন, আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া এমন সব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। অনেক ঘটনা পুলিশের নজরে আসে আবার অনেক ঘটনা আসে না। এ বিষয়টি নিয়ে পুলিশ যথেষ্ট সচেতন রয়েছে।
আত্মহত্যার ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা
আত্মহত্যার ওপর পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৫০ বছরে বিশ্বে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশেই ২ দশমিক ০৬ শতাংশ। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রতি লাখে ২৮ দশমিক ০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। প্রতিবছরই এ সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে।
এদিকে, ছাত্রভিত্তিক সামাজিক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন দাবি করছে, আগের তুলনায় বাংলাদেশে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। এদের মধ্যে নারীর ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ ও পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ।
আত্মহত্যার বিষয়ে নেই কাউন্সেলিংয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে পর্যাপ্ত মানসিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে হতাশাগ্রস্তদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব হতো। আমাদের দেশে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা যা আছে সেটা সীমিত। এসব সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সরকারের ও আমাদের সকলের সহায়তা থাকলে আত্মহত্যার প্রবণতা কিছুটা ঠেকানো সম্ভব হবে। তা ছাড়া পরিবারের সদস্যদের এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
আত্মহত্যা থেকে ফিরে আসছেন অনেকে, নিচ্ছেন মানসিক চিকিৎসা
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকাপ্রকাশের এ প্রতিবেদকের। বর্তমান আত্মহত্যার চেষ্টাকারীরা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে আবার সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৬ বছর বয়সী একটি মেয়ে। সে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। মা ছোটবেলায় ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিনি আর বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। সৎমায়ের কাছে নানা যন্ত্রণায় বেড়ে ওঠা তার। তাই ঘুমের ওষুধ, ব্লেড, দড়ি এমনকি লবণ মিশিয়ে গুঁড়া সাবান খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে মেয়েটি।
কথা হয় আত্মহত্যা থেকে ফিরে আসা ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেলের এক রোগীর সঙ্গে। ওই রোগির নাম আশিক বিল্লাহ (১৬)। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। তিনি দুবার গামছা দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছে।
আশিক বিল্লাহর বিষয়ে জানতে চাইলে তার বড় ভাই আশিকুর বলেন, প্রথমে একবার সে এই ঘটনা ঘটিয়েছে পরে আমাদের মনে হলো ওর চিকিৎসা প্রয়োজন এজন্য চার মাস ধরে চিকিৎসা করছি।
যা জানালেন চিকিৎসক
আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে কেন? কীভাবে এসব রোগীদের চিকিৎসা করেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাহিদা চৌধুরী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, এসমস্ত রোগীরা একাকিত্ব ও বিভিন্ন আতঙ্ক বোধ করেন। আমরা তাদের কৌশলে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। যাতে পরবর্তীকালে এমন কোনো ঘটনা তারা না ঘটান। তবে এর প্রবণতা বাড়ার কারণ হচ্ছে বর্তমানে মানুষ পরিবারকে মোটেও সময় দিতে চাই না। অনেকে কাজে ব্যস্ত থাকে। আমার পরামর্শ হলো কর্মের পাশাপাশি প্রতিটা মানুষের পরিবারকে সময় দেওয়া উচিত। মানুষ এ বিষয়ে সতর্ক থাকলে এই ঘটনাগুলো অনেকটাই কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
করোনাকালে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা
পুলিশ সদরদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, করোনাকাল-২০২১ ও চলতি বছরে মানুষ বেশি আত্মহত্যা করেছে। গত বছরে পুরুষের থেকে নারীর আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল বেশি। সঠিক কোনো তথ্য নেই তারপরও ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত নারীদের তুলনায় পুরুষেরা বেশি আত্মহত্যা করছে।
মহামারিকালে এক বছরে ১০১ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
করোনাভাইরাস মহামারিকালে ২০২১ সালে সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালেয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৬৫ জন পুরুষ, ৩৬ জন নারী। গবেষকরা মনে করছেন, মহামারির মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপে হতাশা বেড়ে যাওয়া এই আত্মহত্যার কারণ হতে পারে।
একটি পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, মহামারিকালে চাকরির চিন্তা, দুশ্চিন্তা, বয়স ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে অনেক শিক্ষার্থী।
পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যাদের সংখ্যা ৩ জন। আত্মহননকারীদের বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২২-২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি।
এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ শতাংশ নারী-পুরুষ। এর বাইরে ২৪ শতাংশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে এবং অজানা কারণে ৩২ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর্থিক ও লেখাপড়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪ ও ১ শতাংশ।
আত্মহত্যার কারণ
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। হতাশ হলে সামান্য কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ থেকে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মন খারাপ থেকেই মূলত মানুষ আত্মহত্যা করে।
সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়ায়, হতাশায় ভোগা আত্মহত্যার কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। গবেষকদের দাবি, যৌতুক, নির্যাতন, বখাটের নিপীড়ন, আর্থিক টানাপোড়েন বা পারিবারিক কলহ মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইনে আত্মহননের চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া আরও বড় অপরাধ।
আত্মহত্যা রোধে করণীয়
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ট্রেন্ড। এই ট্রেন্ডটা মানুষ বেছে নিচ্ছে কেন? এটা একটা বিষয়। এই বিষয়ের ক্ষেত্রে আমার বিশ্লেষণটা হলো, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য নানা ধরনের সম্পর্কে জড়িত হয় বা জড়িয়ে পড়ে। নানা ধরনের সংকট জীবনে তৈরি হয়। সংকটগুলোকে মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাৎ সারাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো, সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলা। সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নিতে হবে। তাহলেই এমন অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।
তিনি বলেন, ব্যক্তির প্রয়োজনে ব্যক্তিকে এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু বিষয়টা হলো আমাদের দেশের আত্মহত্যার বিষয়গুলো সামাজিক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আমরা দেখি। এসব বিষয়ে সরকারেরও একটা ভূমিকা প্রয়োজন। ‘আত্মহত্যাকে না বলুন’ এই স্লোগান সামনে রেখে এগোতে হবে। তাহলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
কোনো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাদের শাস্তি হলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।
কেএম/টিটি