বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস আজ
উপেক্ষিতই থাকল ভোক্তার অধিকার
বাজারে সব ধরনের পণ্যের দামই চড়া। চাল, তেল, ডালসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের এবং ব্যবহার্য্য অন্যান্য সামগ্রীর দামও কোনো কারণ ছাড়াই বেড়েছে। এতে হাঁসফাঁস করছে দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু এর প্রতিকার কী? সাধারণ মানুষের কি জানেতে পারবে নিত্যপণ্যের বাজার কেন ঊর্ধ্বমুখী?
ভোক্তা অধিকার আইন হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। এই আইনের বাস্তব প্রতিফলন খুবই নগন্য। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, পণ্যে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে, পণ্য মজুত করা হচ্ছে, মিথ্যা তথ্যে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে না।
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস আজ। বিশ্ববাসীর মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। এবারের ভোক্তা অধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থায় ন্যায্যতা’। ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে এ দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস কী
১৫ মার্চ, ১৯৬২ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার-ভোক্তাদের এ চারটি মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করেন যা পরবর্তীতে ভোক্তা অধিকার আইন নামে পরিচিতি পায়।
১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে জাতিসংঘ ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরো বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরো আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই কনজুমার্স ইন্টারন্যাশনাল এ সকল অধিকারকে সনদে অন্তর্ভুক্ত করে। কেনেডি'র ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ মার্চকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে বৈশ্বিকভাবে উদ্যাপন করে আসছে।
বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার দিবসের আইন
২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য প্রতিরোধ ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে বিধান করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা হয়।
কী আছে ভোক্তা অধিকার আইনে
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুযায়ী, কোনো বিক্রেতার পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করা, সেবার তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা, পণ্য মজুত করা, ভেজাল পণ্য বিক্রয়, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রতারণা, প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করা, ওজনে ও পরিমাপে কারচুপি, দৈর্ঘ্য পরিমাপের ক্ষেত্রে গজফিতায় কারচুপি, নকল পণ্য প্রস্তুত, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয়, অবহেলা করলে ক্রেতা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
সমস্যা হলো দেশের বেশির ভাগ ক্রেতাই জানেন না প্রতিকার কোথায় ও কীভাবে চাইতে হবে। আর চাইলেই যে প্রতিকার পাওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা আছে কি-না।
রজমান মাস আসছে। সাধারণত এ মাসে নিত্যপণ্যের দামে উর্ধ্বমুখী হতে দেখা যায়। কিন্তু এবছর আগেভোগেই সয়াবিন তেলসহ সব জিনিসের দাম লাগামহীন। সিন্ডিকেট করেই সব জিনিসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ফলে ভোক্তাদের স্বার্থে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গঠন করার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও পুরোপুরি তো দূরের কথা ৫০ শতাংশও কার্যকর হয়নি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাজেশ সরকার ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘মাঝে মধ্যে টিভিতে অভিযান দেখি। ওই সময়ে হয়ত দাম কিছুটা কমে। তারপর আবার বাড়তে শুরু করে। নিয়মিতভাবে বাজার মনিটরিং করা হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করতে পারত না।’
এদিকে অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষেণে সরকারের নির্দেশেই ২০০৯ সালে ভোক্তা আইন করা হয়েছে। এরপর থেকে সারা দেশে এর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে এমন কোনো দিন নেই যে, বাজার মনিটরিং করা হয় না।
একই সঙ্গে নিয়ম ভঙ্গের কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে মনিটরিং করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কেউ অভিযোগ করলে বিক্রেতা দোষি সাবান্ত হলে ক্রেতাকে ২৫ শতাংশও প্রণোদনা দেওয়া হয়।
রবিবারও (১৩ মার্চ) ঢাকা মহানগরের তেজগাঁও এবং শান্তিনগরসহ দেশব্যাপী ভোক্তা-স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন অপরাধে ৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ৭৫ হাজার পাঁচশত টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ভোক্তা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের এপ্রিলে ভোক্তা অধিদপ্তর গঠনের পর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্তে এক যুগের বেশি সময়ে ৫০ হাজারটি বাজার অভিযান পরিচালনা করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। তাতে বিভিন্ন অভিযোগে ৩৭ থেকে ৫৫ নং ধারায় এক লাখ ২০ হাজার ১০২টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে ৮২ কোটি ৪৫ লাখ ৬৭ হাজার ৪২ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এ ছাড়া ভোক্তাদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে ৫৬ হাজার ১২৪টি। এই সব অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ হাজার ২৮১টি প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ কোটি ৯ লাখ ৪৩ হাজার ২০৮ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি অভিযোগকারিকে (ভোক্তা) প্রণোদনা হিসেবে এক কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৭ টাকা প্রদান করা হয়েছে।
ভোক্তা অধিকারের জন্য ২০০৯ সালের ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করার পর এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে সারাদেশে।
আইনের ধারায় দণ্ড
মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করলে অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। পণ্যে ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রয়ের দণ্ড কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় করলে বা করতে প্রস্তাব করিলে অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য, কোন খাদ্য পণ্যের সাথে মিশ্রিত করলে অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত হইবেন।
এ ছাড়া পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্য বা অপরাধের জন্য এক বছর জরিমানা থেকে ৫০ হাজার টাকা বা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এভাবে বিভিন্নভাবে শান্তির বিধান করা হয়েছে আইনে। এছাড়া কেউ অভিযোগ করলে ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দাখিল করতে হবে ভোক্তা অধিদপ্তর থেকে।
এক যুগ পর ভোক্তারা বলছেন, পুরোপুরি নয়, আংশিক বলা যায় ভোক্তাদের স্বার্থ পূরণ করতে পেরেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। ধানমন্ডির অর্চাড পয়েন্টের মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী বলেন, ‘লোক দেখানো অভিযানে লাভ নেই। টিভিতে দেখা যায় অভিযান করছে তখন পণ্যের দাম কমে যায়। তারপর আবার বেড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘বাজার মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে।’
এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভোক্তা ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া কমবে না দ্রব্যমূল্য। পুরণ হবে না ভোক্তাদের স্বার্থ।
শুধু এই কয়জন ভোক্তাই নয়, রবিরার কারওয়ান বাজারে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ভোক্তাদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের একই দাবি, বাজারে মনিটরিং বাড়ালে ভোক্তাদের স্বার্থ পূরণ করতে পারবে ভোক্তা অধিদপ্তর।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাজ করছে, ভোক্তাদের স্বার্থ দেখেছে বলেই তারা প্রতিকার পাচ্ছেন। আস্থার সঞ্চার হয়েছে। তবে প্রত্যাশিত আশা পুরণ করতে পারেনি এ প্রতিষ্ঠানটি।
কীভাবে সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেলায় জেলায় শুধু একজন লোক দিয়ে এটা সম্ভব নয়। অবকাঠামোগত সীমাবন্ধতা রয়েছে। এটা বাড়াতে হবে। আবার ব্যবসায়ীদেরও সতর্ক থাকতে হবে। তবেই সম্ভব। কারণ এমনও শুনা গেছে, একই ব্যবসায়ীকে একাধিকবার জরিমানা করা হয়েছে। তারপরও ভোক্তাদের স্বার্থ বিরোধী কাজ করছে। এটা ভোক্তাবান্ধব দপ্তর। এর কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে।’
জেডএ/