ঢাকায় বেড়েছে চুরি-ছিনতাই
হঠাৎ ঢাকাতে বেড়েছে চুরি-ছিনতাই। আর এই চুরি-ছিনতাই রোধে বিশেষ নির্দেশনায় কাজ করছে পুলিশ। বাড়ানো হয়েছে টহল-তল্লাশি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এসব ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে গুরুতর আহত হওয়ার পাশপাশি ঘটছে প্রাণহানিও। এ ঘটনায় ফেব্রুয়ারি মাসে রাজাধানীতে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। তা ছাড়া এসব চুরি ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে ২ মাসে আহত হয়েছেন ৫০ জন। তারা সবাই ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুলিশী সূত্র এসব তথ্য নিশ্চত করেছেন।
জানা গেছে, ভুক্তভোগীদের অনেকের অভিযোগ- ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রতিকারও মেলে কম। কারণ ঘটনার পর ভুক্তভোগীদের অভিযোগ বা মামলা না করা।
এদিকে ডিএমপি কমিশনার বলছেন, পুলিশকে চুরি-ছিনতাই ঠেকাতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একাধিক ছিনতাইয়ের পর নির্বিঘ্নে এলাকা ত্যাগ করে ছিনতাইকারী দল। পরে চক্রটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়। আটকদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করছে গোয়েন্দারা।
মোহাম্মদপুরেই ভিন্ন কায়দায় দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের শিকার হন এক যুবক। আহত হওয়ার পর কয়েকদিন হাসপাতালেও থাকতে হয়েছে। ঘটনায় জড়িতরাও আটক হয়েছে।
ভুক্তভোগী মো. রুমান খান জানান, ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিতে গেলে তিনি বাধা দেন। তখন চাপাতি দিয়ে তার হাত ও মাথায় আঘাত করে।
গত মাসে রাত ১১টার দিকে কারওরান বাজার বাংলাভিশনের অফিস ভবনের বিপরীতে পার্শ্বে ছিনতায়ের শিকান হন আনিসুর রহমান। তার কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেয় তারা। এরপর আনিসকে ছুরি মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। পরে পুলিশ আনিসকে ঢাকা মেডেকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।
উত্তরার সানজিদা রাফসান জনি নামে এক নারী ভুক্তভোগী জানান, ছিনতাইকারী তার হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নিতে গেলে তার হাতে আটকে যায়। তখন সেই ছিনতাইকারীদের প্রাইভেটকারটি তাকে টেনে হিঁচড়ে কয়েকশ মিটার দূরে নিয়ে যায়।
ছিনতাইয়ের ঘটনায় গেল কয়েক বছরের পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে—২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীতে মামলা হয় ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬টি, ২০১৯ সালে ১৫৫টি, ২০১৮ সালে ২১৬টি, ২০১৭ সালে ১০৩টি, ২০১৬ সালে ১৩২টি, ২০১৫ সালে ২০৫টি ও ২০১৪ সালে ২৬৫টি মামলা দায়ের হয়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ১৩টি। এ ছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ১০টি।
তবে এসব ঘটনায় শুধু থানার মামলার হিসাব এগুলো। বাস্তবে ছিনতাইয়ের ঘটনা আরও বেশি।
এদিকে অভিযোগ দিতে গিয়েও ভুক্তভোগীদের আছে নানান অভিজ্ঞতা। ভুক্তভোগীরা জানান, পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিনতাইয়ের ঘটনা হারিয়ে যাওয়ার নামে সাধারণ ডায়েরি করে এবং এর আর কোনো আপডেট পাওয়া যায় না।
গেল মাসে রাজধানীর তিনটি এলাকায় ছিনতাইকারীর হাতে তিনজন নিহত হয়েছেন। সবগুলো ঘটনার ধরন একই। টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিতে বাধা দিলে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত রাজধানী ঢাকায় সুযোগ পেলেই ছিনতাইকারী চক্র ছোঁ মেরে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগরীতে ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনা ঘটে। পথে পথে ওঁৎ পেতে থাকা ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা দিনে-দুপুরেও ছিনতাই করে। গত মাসে হঠাৎ ছিনতাই চক্রের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছে পুলিশ।
ওই সূত্রটি নিশ্চিত করে বলেন, রাজধানীতে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। দিন-রাতের যেকোনো সময়েই ছিনতাইয়ের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
রাজধানী ঢাকায় গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি দুর্ধর্ষ ছিনতাই সংঘটিত হয়েছে, যা খুবই ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। আলিমুজ্জামান নামে এক ব্যবসায়ী সম্প্রতি ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে আদাবর থেকে রিকশায় ধানমন্ডি যাচ্ছিলেন। রিকশাটি মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ রোডের ব্যাংক এশিয়ার সামনে পৌঁছলে একটি সুজুকি জিক্সার মোটরসাইকেলে করে আসা তিনজন ছিনতাইকারী তার গতিরোধ করে। তারা জোর করে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। পোশাক ও কাগজের ব্যবসায়ী আলিমুজ্জামান এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
ঢাকা মহানগরীর তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, ছিনতাইয়ের ঘটনাটি জানার পর থেকেই কাজ শুরু করেছি। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ব্যক্তি মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেছেন। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই ঘটনার তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।
অপর এক ছিনতাইয়ের ঘটনায় রাজধানীর মিরপুর বাউনিয়াবাদ ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে রায়হান (২৫) নামে এক পোশাককর্মী নিহত হয়েছেন। তার মরদেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় পল্লবী থানা পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
মোশারফ হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী রাজধানীর শ্যামবাজারে মালামাল কিনতে যাচ্ছিলেন। সায়েদাবাদ ফ্লাইওভার ঢাল থেকে দয়াগঞ্জের দিকে যাওয়ার সময় সড়কে ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়েন তিনি। তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ জানিয়েছেন, মোশারফ একজন ভ্রাম্যমাণ হলুদ, মরিচ ও মসলা বিক্রেতা ছিলেন। শ্যামবাজারে মালামাল কিনতে যাওয়ার পথেই ছিনতাইয়ের শিকার হন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। ওই রাতেই যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মোশারফের হত্যাকারী দুই ছিনতাইকারী সজীব (২০) ও শাকিলকে (২০) গ্রেপ্তার করে। তারা এর আগেও যাত্রাবাড়ীতে একটি ছিনতাইয়ে হত্যা মামলার আসামি ছিল। আদালত থেকে জামিনে তারা বের হয়ে ফের ছিনতাই কাজে নেমেছে। এর পেছনে আর কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
একই দিনে মিরপুরে এক বিদেশি নাগরিক ছিনতাইয়ের শিকার হন। তার কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় অভিযান চালিয়ে ১০ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া, গত এক সপ্তাহের মধ্যেই তেজগাঁও, তুরাগ, দক্ষিণ খান, ডেমরা, খিলগাঁও, হাজারীবাগ ও বাবু বাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলছেন, হঠাৎ করে ছিনতাই বেড়ে গেলেও কর্তব্যরত মাঠ পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার ৫০ থানা এলাকার বেশিরভাগ স্থানেই রাত ১০টার পর সড়কে কোনো পুলিশ থাকে না। টহল পুলিশের গাড়িও চোখে পড়ে না বলে ভুক্তভোগীদের দাবি। ফলে অরক্ষিত সড়কে রিকশা আরোহীসহ চলাচলরত সাধারণ মানুষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন। এসব ছিনতাই ঘটনার শিকার বড় একটি অংশ থানা পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না।
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন নামে একজন ভুক্তভোগী বলেন, রাত ১টার দিকে মোটরসাইকেলে করে মিরপুর থেকে সূত্রাপুর যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময়ে সড়কে কোনো পুলিশকে দেখতে পাননি তিনি। মিরপুর থেকে সূত্রাপুরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। এই বিশাল দূরত্বে কোনো টহল পুলিশ না দেখতে পেয়ে অনেকটা ভয়ও পেয়েছিলেন তিনি। সূত্রাপুরে দু’জন ছিনতাইকারী মোটরসাইকেল থামিয়ে ফোন আর মানিব্যাগে থাকা টাকা নিয়ে চলে যায়। ‘পুলিশের বাড়তি ঝামেলা এড়াতে’ মামলা করেননি বলে জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) হাফিজ আল আসাদ বলেন, ছিনতাই চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের পুলিশের বিভিন্ন অভিযান চলমান রয়েছে। এসব অপরাধ দমনে পুলিশ সবসময় সোচ্চার।
জানতে চাইলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার আ স ম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা পুলিশকে জানান না। কী কারণে এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে তা প্রায় পুলিশের অজানা। তবে এসব রোধে আমরা কাজ করছি।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছেন, সচেতন নাগরিকদের ছিনতাইয়ের ঘটনা অবশ্যই পুলিশকে জানানো উচিত। তিনি বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেছেন, ছিনতাই প্রতিরোধে গোয়েন্দা পুলিশের প্রায় ৭০টির মতো টিম পুরো ঢাকা শহরে দায়িত্ব পালন করছে। এর মধ্যেও দুয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে বেশিরভাগ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুয়েকটি ঘটনায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা শীঘ্রই তাদেরও গ্রেপ্তার করতে পারব। পুলিশের দাবি ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়লেও তা এখনও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি। তবে সম্প্রতি ছিনতাইয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ঘটনায় আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি দুয়েকটি ঘটনায় তদন্তের কাজ অব্যাহত রয়েছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, সম্প্রতি আমরা কয়েকটি ছিনতাই চক্রকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি। তারা মূলত অটো রিকশা, ভ্যান, ট্যাক্সি, বাসাবাড়িসহ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই করত। দীর্ঘদিন ছিনতাই করতে করতে তারা খুনের সঙ্গে জড়িত হয়। সম্প্রতি সাভার-আশুলিয়ায় এক চালককে তারা খুন করে। ওই ঘটনার সূত্র ধরে এ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে আমরা আইনের আওতায় এনেছি।
তিনি বলেন, এ ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।
র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, র্যাব সব সময় বিভিন্ন অপরাধ দমনে তৎপর রয়েছে। আমরা ভিকটিমদের অভিযোগের ভিত্তিতে চুরি ছিনতাই ও এ ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকি।
তিনি বলেন, সম্প্রতি অনেক চুরি ছিনতাই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ব্যস্ত শহরে ছিনতাই ঠেকানো একেবারে সম্ভব নয়। এজন্য নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। সবাই সচেতন হলে এসব অপরাধ কমে আসবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, রাজধানীসহ ঢাকার আশেপাশে হঠাৎ করে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটছে এবং মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে।
তিনি বলেন, ঘটনাগুলোর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। সেসব বিষয় চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে। এই বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্রদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযান চলমান রাখলে হয়তো এসব অপরাধ কমে আসবে।
তবে সাধারণ মানুষকে এসব বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন হতে হবে বলে জানান এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ।
কেএম/টিটি