৫ বছরেও মিলেনি স্থলবন্দর ভূমি অধিগ্রহণের টাকা
প্রায় ৫ বছর আগে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হলেও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসনের গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে নির্মাণাধীন বাল্লা স্থলবন্দরের জন্য অধিগ্রহণকৃত ভূমি মালিকদের টাকা। কবে টাকা পাবে কিংবা আদৌ পাবে কিনা- তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ভুমির মালিকরা। ভূমি হারিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছে তারা। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি- জেলা প্রশাসনকে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, জেলা প্রশাসন বলছে আইনী জটিলতা মানে একাধিক মামলা থাকার কারণে সবাইকে টাকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কেদারাকোট নামক স্থানে নির্মিত হচ্ছে ‘বাল্লা স্থলবন্দর’। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়মুড়া এলাকার সাথে এ স্থলবন্দর দিয়ে সংযোগ স্থাপিত হবে। এই স্থলবন্দরের নির্মাণ কাজ প্রায় ৬০ ভাগ শেষ। অথচ এখনও সেখানকার অধিকৃত ভূমির মালিকদের জমির মূল্য দেয়া হয়নি। যে কারণে তাদেরকে এখন নির্মাণাধীন স্থলবন্দরের ভেতরে খুব কষ্টে বসবাস করতে হচ্ছে। তাদের ভবিষ্যতে কি আছে, এনিয়ে শংকা রয়েছে সেখানকার মানুষের মধ্যে। ভূমি মালিকরা তাদের অভিযোগ ও শংকার কথা জানান।
আমি খুব কষ্ট করে দিনমজুরী করে এ জায়গা ক্রয় করেছি। এখন সরকার যেহেতু জায়গা নিয়ে গেছে, আমরা সরকারের বাধ্য হয়ে জমি দিয়েছি। এখন যে পর্যায়ে আছি, থাকার কোন পরিবেশ নেই। ২-৩০০ লোক এখানে কাজ করে। আমরা এখন অসহায় অবস্থায় আছি। রাতে এত মানুষের ভীড়ে কোন নিরাপত্তা নেই। সরকারও কোন টাকা দিচ্ছে না। বলেন মরম আলী।
তিনি আরও বলেন, এখন কোথায় গিয়ে বাসস্থান করব প্রশ্ন করে বলেন, আমরা অসহায় মানুষ। কোথাও গেলে কোন গুরুত্ব পাই না। জেলা প্রশাসকের অফিসে গেলেও আমাদের কোন গুরুত্ব দেয় না। বলে আমাদের ভেজালের কারবার। আমি দিনমজুর মানুষ। একটা ঘর বানানোর তওফিকও নাই। সেখানের আরেকজন নারী বলেন, বলা হয়েছিল গাছের টাকা আলাদা দেবে। বাঁশের টাকা আলাদা দেবে। আমরা একটা টাকাও পাইনি। আমাদের মত অসহায় আর জগতে নাই। আমি চারটা বাচ্চা নিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়ছি। বলার মত না।
কেদারাকোট এলাকার খুর্শেদ আলীর ছেলে আবুল কালাম বলেন দীর্ঘদিন যাবত বন্দরের কাজ চলতাছে। বন্দরের ভেতরে আমাদের বাড়িঘর পড়ছে। আমাদের টাকা-পয়সা দিতেছে না। কেন যে দিচ্ছে না তারাই জানে। একটার পর একটা তারিখ দেয়। আমরা গেলে এই তারিখে না সামনের তারিখে আইসেন। এভাবে আমাদের ঘুরাচ্ছে। ডিসি অফিসে গিয়ে ঘুরছি। কিন্তু কবে যে আমাদের টাকা দেবে তা নির্দিষ্ট তারিখ দিচ্ছে না। আমাদের কাগজপত্র সম্পূর্ণ ঠিক আছে। বাড়িঘরও বন্দরের ভেতরে রয়েছে। কাগজ যার জায়গা তার, এভাবে আমাদের টাকা দিয়ে দিলেই হয়।
সরেজমিনে ঘুরে ও স্থলবন্দরের দায়িত্বে থাকা লোকজনে সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থলবন্দরের চারদিকে দেয়াল ওঠে গেছে। দেয়ালের মধ্যে কিছু ফাঁকা জায়গা দিয়ে অধিগ্রহণকৃত ভূমির লোকজন যাতায়াত করেন। আর স্থলবন্দরের কাজ পুরোদমে চলছে। প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে দাবি করেছেন স্থলবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, বাল্লা স্থলবন্দরের জমি অধিগ্রহণের কাজ ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে। বিভিন্ন জটিলতা শেষে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। অধিগ্রহণের পুরো টাকা হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও অর্ধিকৃত ভূমি মালিকদের সহায়তার জন্য স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, প্রজেক্ট ডিরেক্টর, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, প্রজেক্ট ডিরেক্টর মহোদয় বলেছেন আপনারা টাকা পেয়ে আস্তে-ধীরে যান। এখনই যেতে হবে না। যে জায়গায় কাজ হচ্ছে, সেখানকার বসতিগুলো অনেকে স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। তারা খুশি মনে চলে গেছেন। যারা কিছু অংশ পেয়েছেন বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও প্রজেক্ট ডিরেক্টর মহোদয় তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে বলেছেন।
জেলা প্রশাসনের বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, প্রায় অর্ধশতাধিক ভূমি মালিকদের মধে ২/৩ জন টাকা পেয়েছেন। কয়েকদিনের মধ্যে আরো কয়েকজন পাবেন। বাকীগুলো মামলা-মোকদ্দমার জন্য পিছিয়ে জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, আমরা দেয়ার চেষ্টা করছি। টাকা মজুদ আছে। আইনী জটিলতা মানে একাধিক মামলা থাকার কারণে সবাইকে টাকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যারা মামলা নিষ্পত্তি করে কাগজপত্র নিয়ে আসবেন, তাদেরকে টাকা বুঝিয়ে দেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের ত্রিপুরায় সীমান্ত সম্মেলনে একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত-বাংলাদেশ সরকার। চুনারুঘাটের কেদারাকোট এলাকায় ১৩ একর জমির ওপর ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাল্লা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের প্রতিনিধিরা সরেজমিন পরিদর্শন করে নির্মাণকাজ শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। প্রাথমিকভাবে স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য ৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় দীর্ঘদিন আটকে থাকে। ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর বন্দর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
এএজেড