অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশে ট্রেন দীর্ঘদিন ধরেই সাশ্রয়ী, আরামদায়ক ও জনপ্রিয় গণপরিবহন। বিশেষ করে ঈদ বা বড় কোনো উৎসব সামনে এলেই যাত্রীচাপে ভরপুর হয়ে ওঠে রেলস্টেশনগুলো। কিন্তু চাহিদা বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়েনি রেলের সক্ষমতা। বরং ইঞ্জিন, কোচ ও জনবলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের ৭৯টি ট্রেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ২৭৫টি ট্রেন চলাচল করছে, যার মধ্যে আন্তঃনগর ১২০টি, কমিউটার ও মেইল ১২৮টি, কনটেইনার ট্রেন ৮টি এবং গুডস ট্রেন ১৯টি। অন্যদিকে বন্ধ রয়েছে ৭৯টি লোকাল, মিশ্র ও ডেমু ট্রেন। বন্ধ ট্রেনগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই চলাচল না করা অনেক রুটের ট্রেন, আবার কিছু ট্রেন সাম্প্রতিক সময়েও ইঞ্জিন বা কোচ স্বল্পতার কারণে বন্ধ হয়েছে।
বয়স পেরিয়েছে ইঞ্জিনের, কমছে সক্ষমতা-
রেলের বহরে বর্তমানে ২৯৭টি ইঞ্জিন থাকলেও এর অর্ধেকের বেশি অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে মিটারগেজ ইঞ্জিন ১৬৭টি ও ব্রডগেজ ইঞ্জিন ১৩০টি। ২০ বছর মেয়াদি আয়ের বিবেচনায় কেবল ১৪৭টি ইঞ্জিন এখনও কার্যক্ষম হিসেবে বিবেচিত। বাকি ১৫০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ৮৪টির বয়স ৪০ বছর ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় ট্রেন চালু রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
যেসব ট্রেন এখন বন্ধ-
ইঞ্জিন ও কোচ সংকটে পূর্বাঞ্চলে বন্ধ রয়েছে ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, আখাউড়া, লাকসাম, নোয়াখালী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ রুটের ৩৬টি ট্রেন। পশ্চিমাঞ্চলে বন্ধ আছে ৩৭টি ট্রেন, যেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ লোকাল ও মিশ্র ট্রেন। এর পাশাপাশি ভারতগামী বন্ধন, মৈত্রী ও মিতালি এক্সপ্রেসও দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রয়েছে।
কিছু উল্লেখযোগ্য ট্রেন বন্ধের সময় ও কারণ-
ইঞ্জিন ও ক্রু সংকটে: ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস, কুশিয়ারা এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কমিউটার।
আন্ডার রিপেয়ার: রংপুর ও পঞ্চগড় কমিউটার (ডেমু), নারায়ণগঞ্জ কমিউটার।
নাশকতার আশঙ্কায়: ঈশ্বরদী-রাজশাহী লোকাল (২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বন্ধ)।
যাত্রী সংকটে: চন্দনা/ভাঙ্গা কমিউটার (২০২৪ সালের আগস্টে বন্ধ)।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, "ইঞ্জিন কিনতে চাইলে সেটি দ্রুত হয় না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। অর্থ পাওয়া গেলেও টেন্ডার, অর্ডার, আমদানি—সব মিলিয়ে ইঞ্জিন পেতে সময় লাগে ২-৩ বছর।" তিনি জানান, বর্তমানে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ মিলিয়ে প্রায় ৯০টি নতুন ইঞ্জিনের প্রয়োজন রয়েছে। ইতোমধ্যে এডিবির অর্থায়নে ৩০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, “রেলের সমস্যা দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাহীনতা। মাস্টারপ্ল্যান থাকলেও বাস্তবায়নে গাফিলতি আছে। সময়মতো লোকবল নিয়োগ বা ইঞ্জিন কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এখন রেললাইন বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু ইঞ্জিন-কোচ বা দক্ষ জনবল নেই। আউটসোর্সিংয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।”