কালেমা তয়্যেবা স্বাধীনতার ঘোষণা
ইসলামের প্রথম বাক্য এবং ঈমানের মূল হলো কালেমা তয়্যেবা। কালেমা অর্থ শব্দ, বাণী বা বাক্য; তয়্যেবা অর্থ পাক পবিত্র। কালেমা তয়্যেবা অর্থ পবিত্র বাণী, পাক কলাম বা পরিশুদ্ধ ঘোষণা। ইসলামের মূল বাণী পবিত্র কালেমায় এই ঘোষণাই দেওয়া হয়েছে: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” অর্থাৎ ‘এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো প্রভু নাই, হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসূল’। এই ঘোষণার পর মানুষ মানব দানব সকল প্রকার প্রভুর গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এবং আদর্শ হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে গ্রহণ করে। এই কালেমা দ্বারা মানুষ মানব দানব সকল সৃষ্টির পরাধিনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে।
স্বাধীনতা আল্লাহর নিয়ামত। স্বাধীনতা যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, তেমনি ইসলামের মূল শিক্ষা। তাই রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু দাস মুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি; তিনি দাসকে সন্তান বানিয়েছেন, তিনি কৃতদাসকে ভায়ের মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছেন, তিনি গোলামকে সেনা অধিনায়ক বানিয়েছেন। বংশানুক্রমিক দাসানুদাস আফ্রিকান কাফ্রি নিগ্রো হাবশী বিলাল (রা.) কে মসজিদে নববীর প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে আরব অনারব, ধনী দরিদ্র সবাই ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নিয়েছে। রুম পারস্যসহ সারা পৃথিবীতে ইসলামের স্বাধীনতার বাণী বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত বর্ষের শ্রেণী বৈষম্য ও বর্ণ বৈষম্যের শিকার নির্যাতিত নিপীড়িত কোটি কোটি মানব সন্তান স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করার জন্য পবিত্র কালেমা তয়্যেবার শরাবান তহুরা অমৃতসুধা পান করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। মুক্তির সুধা পান করেছে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠির মানুষ।
স্বাধীনতার জন্যই দাতা গঞ্জে বখশ আবুল হাসান আলী হুজবেরী (র.) এর হাতে লাহোর করাচি ও পাঞ্জাবের লাখ লাখ শান্তিকামী লোক ইসলাম গ্রহণ করে। সেই একই সূত্রে পৃথ্বিরাজের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গরীব নাওয়াজ (গরীবের বন্ধু) হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর হাতে ভারতের প্রায় নব্বই লাখ মুক্তিকামী লোক ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নেয়। রাজা গৌড়গোবিন্দের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হযরত শাহ জালাল মুজাররাদ আল ইয়ামানী (র.) এর সাথে ঐক্যমত্য ঘোষণা করে বঙ্গের মজলুম নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ।
আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। স্বাধীনতা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বাড়িয়ে দেয়। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে মানুষ! আমি তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদিগকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সহিত পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। (সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।
জগতের সকল মানুষ একই পিতা মাতার সন্তান। সকলেরই পিতা বাবা আদম আলাইহিস সালাম, সকলেরই মাতা মা হাওয়া আলাইহাস সালাম। তাই সকল মানুষ ভাই ভাই, তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নাই। সাদা কালো, লম্বা খাটো সেতো আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতির অবদান। বর্ণ বৈষম্য, ভাষা বৈষম্য এবং ভৌগলিক ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ তৈরি করে না। বিদায় হজ্জের ভাষণে নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘কালোর উপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারী শরীফ)। অর্থাৎ কেউ কারো উপর প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে না। সবার একমাত্র প্রভু মহান আল্লাহ।
ভালো মন্দ, সত্য মিথ্যা ও ন্যায় অন্যায় বুঝার জন্য আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন। চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং কর্ম অনুযায়ী পরকালে বিচার হবে। কর্মফল অনুসারে জান্নাত বা জাহান্নামের অধিকারী হবে। তাই আল্লাহ এই জগতে মানুষকে কোনো কাজে বাধ্য করেন না। এমন কি ধর্ম কর্ম বিষয়েও জোর করা হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন: “ইসলামে জবরদস্তি নাই, সত্যাসত্য সুস্পষ্ট পার্থক্য হয়ে গেছে। যারা তাগূত তথা অশুভ অসুর শক্তিকে অস্বীকার করে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলো; তারা মজবুত হাতল দৃঢ়ভাবে ধারণ করলো, যা কখনো ভাংবার নয়; আল্লাহ সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী।” (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৫৬)। “আমি কি তাকে তার জন্য দুটি চক্ষু সৃষ্টি করিনি? আর জিহ্বা ও ওষ্ঠ অধরদ্বয়? আমি তাকে ভালো-মন্দ দুটি পথ দেখিয়েছি।”
(সূরা-৯০ বালাদ, আয়াত: ৮-১০)। “তাকে পরীক্ষা করার জন্য, আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন।
আমি তাকে পথ নির্দেশ দিয়েছি, হয় তো সে কৃতজ্ঞ হবে, নয় তো সে অকৃতজ্ঞ হবে।” (সূরা-৭৬ দাহার, আয়াত: ২-৩)। “কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কুফরী করে এবং মুশরিকরা জাহান্নামের অগ্নিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে; তারাই সৃষ্টির অধম। নিশ্চয় যারা ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের জন্য পুরস্কার হিসেবে রয়েছে স্থায়ী জান্নাত; যারা নিরুদেশ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত হয়, সেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এটি তার জন্য যে তার প্রতিপালককে সমীহ
করে।” (সূরা-৯৮ বায়্যিনাহ, আয়াত: ৬-৮)।
মানুষ সৃষ্টিগতভাবে ও জন্মগতভাবে স্বাধীন। স্বাধীনতা মানুষের মজ্জাগত, এটি মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি। মানুষ মনোজগতে সবসময় স্বাধীন; তাই সে বস্তুজগতেও স্বাধীন থাকা পছন্দ করে। মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামী করবে না, করবে না কারো দাসত্ব; এক আল্লাহর প্রভুত্ব ছাড়া কারো প্রভুত্ব স্বীকার করবে না; হোক সে নমরূদ-ফেরাউন বা কোন দেব দেবতা।
ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে অনেকে পরিবারে ও সমাজে এমন কাজ করে যা অন্যদের অনেকের অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়ায়। মনে রাখতে হবে ব্যক্তিগত বিষয় ততক্ষণ ব্যক্তিগত থাকে যতক্ষণ এর সাথে কারো পছন্দ অপছন্দ যোগ না হয়। অর্থাৎ যতক্ষণ এর প্রভাব ও ফলাফল শুধু ব্যক্তির নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
যখনই তা পরিবারের কোনো সদস্যকে উদ্দিপ্ত করবে, তখন তা হয়ে যাবে পারিবারিক; যখন তা সমাজের কোনো সভ্যকে প্রভাবিত করবে, তখন তা হয়ে যাবে সামাজিক; যখন তা রাষ্ট্রের কোনো নাগরিককে উদ্বুদ্ধ করবে, তখন তা হয়ে যাবে জাতীয়। মানুষ সামাজিক জীব হওয়ার কারণে তার জীবনের ব্যক্তিগত পরিসর খুবই সীমিত। স্বাধীনতা মানে সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা, সত্য গ্রহণের স্বাধীনতা, সত্য প্রচারের স্বাধীনতা, সত্য সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলার। স্বাধীনতা হলো সুন্দর, সুশীল, সুকুমারবৃত্তির চর্চার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে অসুন্দরকে বর্জন করার স্বাধীনতা, অসত্যতে অগ্রাহ্য করার স্বাধীনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি: শেখ ছাদী (রহ.) ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ