বাঙালির স্বাধীনতার সড়ক নির্মাণে অনন্য ৭ই মার্চের ভাষণ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ভাষণ দেন পাকিস্তানি স্বৈরশাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারই নেতৃত্বে ২৩ বছরের ধারবাহিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে। বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির সড়ক নির্মাণে অনন্য দূরদর্শী এ ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের বিশ্লেষণ করতে হলে প্রাসঙ্গিকভাবেই স্বাধীনতার উদ্ভব কবে কখন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার। স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যাপ্তি ২৪ বছর। আর এই স্বাধীনতার ভাবনা আসে উনিশ সাতচল্লিশে। ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটন ভারতবর্ষ ভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করলে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব কোলকাতার সিরাজউদ্দোলা হলে ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে এক রুদ্ধদার বৈঠকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান হতে যাচ্ছে, এই স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়। হয়তো বাংলার মাটিতে নতুন করে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মযহারুল ইসলাম। আগামী প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৯৪)। পাকিস্তান সৃষ্টির পর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে শুরু হয় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। বাংলার স্বাধীনতার চিন্তা মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু এই আন্দোলনের সাথে গণতন্ত্র, শোষণ-বৈষম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও ৬-দফভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন যুক্ত করায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ধাপে ধাপে আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করেন। এরই ধারবাহিকতায় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ন হওয়ার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল দূরদর্শী, প্রজ্ঞা ও বোধসম্পন্ন একটি ভাষণ, যা বিশ্বইতিহাসের অবিস্মরনীয় উপাদানে পরিণত হয়। এ ভাষণ স্থান পেয়েছে আব্রাহাম লিঙ্কন, জুলিয়াস সিজার, নেপেলিয়ান, গ্যারিবল্ডি, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনসহ ৪১ জনের বিশ্বসেরা ভাষণ সংকলিত করে প্রকাশিত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইনস্পায়ারড হিস্টোরি’ গ্রন্থে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অনেকেই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ অ্যাডড্রেস এর সঙ্গে তুলনা করেন। লিঙ্কনের ২৭২ শব্দের সংক্ষিপ্ত ভাষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের অবসান এবং ঐক্যবদ্ধ মার্কিন জাতির অভ্যূদয় ঘটায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির সড়ক নর্মাণ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অনিবার্য করে তোলে। ভাষণে তিনি স্বাধীনতা অর্জনের সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দশনা দেন। তাঁর এ সম্মোহনী ভাষণে অপনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হয়ে বাঙালিরা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সবচেয়ে লক্ষনীয় দিক হলো বাক্যগুলো সুবিন্যস্ত এবং প্রায় প্রতিটি বাক্যই গভীর অর্থবোধক। এতে উঠে এসেছে একটি জাতির ইতিহাস, ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের চিত্র এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে বাঙালিদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হবার কথা। আরও উঠে এসেছে মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামে অংশগ্রহণের কথা এবং জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা। কোন কৌশলে যুদ্ধ ও জনযুদ্ধ পরিচালিত হবে রয়েছে সে কথা এবং যুদ্ধাবস্থায় সর্বস্তরের মানুষের করণীয় সম্পর্কে আগাম দিক-নির্দেশনা।
ভাব, ভাষা ও শব্দ প্রয়োগ এবং চয়নে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এক মহাকাব্যিক ভাষণ। এ ভাষণ শুনে উনিশশ একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলির ঘটনাপ্রবাহ কভার করতে আসা বিশ্বখ্যাত নিউজইকের সাংবাদিক ৫ এপ্রিল সংখ্যার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম দেন ‘পোয়েট অব পলিটিকস’। প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লেখা হয় এভাবে-‘৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার আপদমস্তক বাঙালি, ধূসর ঝাকড়া চুল, পুরু গোঁফ ও তীক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী মুজিব আবেগঘন বক্তৃতার দ্বারা ১০ লক্ষ মানুষকে যাদুমন্ত্রের মতো সম্মোহিত করে রাখতে পারতেন। উর্দু, বাংলা এবং ইংরেজি-এই তিন ভাষায় অনর্গল কথা বলায় পারদর্শী মুজিব একজন চিন্তাবিদ হওয়ার ভান করেনি, তিনি প্রকৌশলীও নন, তিনি রাজনীতির কবি। শৈল্পিক স্টাইলে তার বক্তৃতার মূল লক্ষ্য ছিল এ অঞ্চলের সকল শ্রেণি ও আদর্শের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রতিটি বাক্যই গভীর অর্থবোধক এবং তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এমনকি অনেক শব্দও। অলিখিত ভাষণ, কিন্তু তিনি সুচিন্তিতভাবে শব্দ ও বাক্যের প্রয়োগ করেছেন। ১৯ মিনিটের ভাষণে রয়েছে ১০১টি বাক্য। শব্দ সংখ্যা ১১০৮টি। বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তির কথা বলেছেন তিনবার। বলেছেন বাংলার মানুষের অধিকারের কথা। মুক্তি বলতে তিনি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিসহ জনগণের সার্বিক কথা বলেছেন। প্রথমে সাংস্কৃতিক মুক্তির কথাই ধরা যাক। উনিশশ সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরের মধ্যে বাঙালির সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসে। বাঙালিরা সব সময়ই ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ। বাংলা ভাষার ওপর আঘাত মানে সংস্কৃতির ওপর আঘাত। উনিশশ আটচল্লিশের ২ মার্চ মাত্র ৭ দশমিক ২ ভাগ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। শুরু হয় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানে এটা ছিল তার প্রথম গ্রেপ্তার।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক মুক্তি। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালির রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনও স্টিম রোলার চালিয়ে, আবার কখনও সামরিক শাসন জারি করে। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বাঙালির স্বাদেশিকতার রাজনৈতিক অধিকার অর্জন বা পলিটিক্যাল ইনডিপেনডেন্স প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক মুক্তি। সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান বৃহত্তর হওয়া সত্ত্বেও সরকারি বজেটের প্রায় পুরোটাই খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য। বৈদেশিক সাহায্যের আশি ভাগই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য। চাল, আটা, তেলের দাম পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল দ্বিগুন। এসব বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন থেকে মুক্তি দিতে বঙ্গবন্ধু উনিশশ ছেষট্টিতে বাঙালির মুক্তি সনদ (ম্যগনাকার্টা) ছয় দফা ঘোষণা করেন।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু উনিশশ সত্তরের নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আতাঁতে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল দেখে ভুট্টোর মাথা বিগড়ে যায়। এ নির্বাচনে আাওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় অর্জিত হয়। নির্বাচনে ৩০০ আসনের গণপরিষদে জনসংখ্যা অনুপাতে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি। আর পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩১ আসনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি পায় ৮১টি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ডেজিগনেটেড প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবের পরামর্শমতো ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশন না ডেকে ভুট্টোর কথামতো ৩ ফেব্রুয়ারি অধিবেশন ডাকেন। বাড়তি সময় নেওয়ার কারণ ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে সংসদ সদস্য যারা তলে তলে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দিতেন তাদের ‘ম্যানেজ’ করা। যারা ৩ মার্চ আহুত অধিবেশনে যোগ দেবে তাদের পা কেটে ফেলার হুমকি দেয় ভুট্টো। হুমকি উপেক্ষা করে ৩৫ জন সদস্য ঢাকায় আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১ মার্চ সাড়ে বারোটায় গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেয়।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপের গণতন্ত্রে। তিনি ছিলেন উদার গণতন্ত্রী। ৭ই মার্চের ভাষণেও এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। তিনি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছেন গণতান্ত্রিক ধারায়। ১৯৭১ সালের মার্চে সশস্ররূপ লাভের আগ পর্যন্ত আন্দোলনকে সহিংসরূপ নিতে দেননি। তিনি এতটাই ন্যায্যতার পক্ষের ছিলেন একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে তা তিনি মেনে নেবেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া একজন নেতা সংখ্যালঘু, আবার তাও যদি একজনও হয় তা মেনে নেবার কথা বলতে পারেন?
বঙ্গবন্ধু খুব ভাল করেই জানতেন পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ জনগণের উপযুক্ত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত জুড়ে দেন, যা পাকিস্তানের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়। শর্তগুলো হলো: এক. সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে; দুই. সামরিক বাহিনীর সমস্ত সদস্যকে ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে; তিন. যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে; চার. জনগণের উপযুক্ত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। শর্ত মানলে পাকিস্তান টিকবে অন্যথায় না।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন ভাল কমিউনিকেটর ও সুবক্তা। কোথায় কোন বক্তব্য দিতে হবে তা খুব ভাল জানতেন। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি মানুষের স্বপ্ন-আকাঙক্ষা বিবেচনায় নিয়ে শব্দ এবং বাক্যের প্রয়োগ করেছেন। যেমন ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’। এখানে প্রমিত বাংলায় না বলে আঞ্চলিক শব্দ ‘দাবায়ে’ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু দাবায়ে শব্দ অপ্রমিত হলেও শক্তিশালী শব্দ। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গ্রোথিত হওয়ার মতো শব্দ। ঠিক এমনিভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি’। একেবারেই সাধারণ মানুষের মুখ নিসৃত কথাই যেন তাঁর মুখে উচ্চারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আন্ত:ব্যক্তিক যোগাযোগ ও কথা বলার ভঙ্গিমা নিয়ে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এর সাংবাদিক র্যালফ ব্লুমেন্টাল। পত্রিকাটির ৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ সংখ্যায় ‘আনডিসপুটেড লিডার অব দ্য বেঙ্গলিস’ শিরোনামে একজন কূটনীতিককে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব যদি একজন ব্যক্তির সাথেও মুখোমুখি বসে কথা বলেন মনে হবে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে ৬০ হাজার মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছেন।’
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগ্রত করেছেন। ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বেঙ্গলি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই’। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। এই আন্দোলন নস্যাতে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাই বঙ্গবন্ধুর ভয় ছিল পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ অতীতের ন্যায় সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে আন্দোলন বিভ্রান্ত বা বানচালের চেষ্টা করতে পারে। এ কারণেই তাঁর সাবধানবানী। ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে’। এ কারণে তিনি সকল সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মানুষকে নিজের ভাই মনে করে তাদের সতর্ক করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মূল প্রতিপাদ্য শেষোক্ত বাক্যটি। তিনি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা’ বলে বক্তব্য শেষ করেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তি বলতে যে জনগণের সার্বিক মুক্তির কথা বলেছেন সে কথা আগেই বলেছি। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে একমাত্র স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন উপায়ে তা সম্ভব নয়। তাই তার আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। ৭ই মার্চে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি কার্যক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পূর্ব বাংলা শাসন করেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভাষায় এই সময়কাল হলো ডিফ্যাক্টো রিজিম, আর মুজিব হলেন ডিফ্যাক্টো রাষ্ট্র প্রধান। ওয়াশিংটন পোস্ট ২১ মার্চ ১৯৭১ সংখ্যায় ‘মুজিবুর: ভার্চুয়াল রুলার অব ই.পাকিস্তান’ এবং ১০ মার্চ ‘দ্য ইভনিং স্টার পত্রিকায় ‘ডিফ্যাক্টো গভর্নমেন্ট ঢাকা ডিসিডেন্ট ইন পাওয়ার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন কৌশলী, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক। তিনি এমনভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন যাতে তার ওপর বিছিন্নতাবাদের দায় না আসে। নিউজউইকের ‘পেয়েট অব পলিটিক্স’ শিরোনামে লিখিত প্রবন্ধে সাংবাদিক লোরেন জেনকিংকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ÒThere is no hope of salvaging the situation. The country as we know it is finished. We are the majority so we cannot secede. They are the Westerners, are the minority, and it is up to them to secede.”
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা। একজন সিভিলিয়ান নেতা চমৎকারভাবে গেরিলাযুদ্ধের নীতি ও কৌশল তুলে ধরেছেন। একদিকে বলেছেন ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, অপরদিকে জনগণকে চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে উৎখাত করে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য যা যা করা দরকার তাঁর নির্দেশ ছিল ভাষণে। সেনাছাউনিতে সব সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি বাঙালি পাচকদের সেনাবাহিনীর জন্য খাবার রান্না করা নিষেধ ছিল।
ভাষণের শেষ বাক্য দুই শব্দের ‘জয় বাংলা’। জয় বাংলা বলেই তিনি বক্তব্য শেষ করেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘পূর্ণ- অভিন্দন’ কবিতা থেকে নেওয়া এই জয় বাংলা বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল। জয় বাংলা বলে তিনি ভাষণ শেষ করেন। এই জয় বাংলা শুধু রণধ্বনি নয়, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র। এই জয় বাংলা ধ্বনি জাতি-ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে। জয় বাংলা বলেই স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মহুতি দেয়। নয় মাসের রক্তস্নাত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে।
এ নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের কয়েকটি বাক্যের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিন্তু ভাষণের অন্তত ২৯টি বাক্য এবং এমন কিছু শব্দ রয়েছে যা নিয়ে গবেষণা হতে পারে এবং রচিত হতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা গ্রন্থ।
(লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও বাসসের সাবেক সিটি এডিটর)