অসাধারণ ভাষণটির বিশ্বজয়
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ঘোষণা দিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ‘বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ। ইউনেস্কো জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা। এই স্বীকৃতি ইতিহাসের বড় সময় ধরে বিশ্বজুড়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি করেছে। বলতেই হবে বাঙালি-বাংলাদেশের ইতিহাস এই ৭ই মার্চের ইতিহাস। ইউনেস্কোর মাধ্যমে বাঙালির অর্জন বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্য মানবজাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। অনুপ্রেরণা প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে মানুষের মানবিক অধিকারকে নিশ্চিত করে।
চল্লিশের দশকে প্রখ্যাত মনীষী এস. ওয়াজেদ আলি এমন একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন-বলেছিলেন এই জাতি একজন মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘এখন বাঙালি কেবল ভারতবর্ষের নয়, কেবল প্রাচ্য ভূখন্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে-সত্য, সুন্দর, শুভ জীবন- পথের।’ আশাটা কি বেশি করা হয়েছিলো যে বাঙালি শুধু ভারতবর্ষের নয়, প্রাচ্য ভূখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে? অথচ কী আশ্চর্য, চল্লিশের দশক থেকে ষাটের দশক -মাত্র দু-দশক সময়ের ব্যবধানে এমন একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের ভাষণের স্বীকৃতি বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শকের জায়গায় স্থান দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু এমনই এক রাজনৈতিক নেতা যিনি ভারত উপমহাদেশের মানচিত্র বদলে দিয়েছেন। বাঙালিকে যোদ্ধা জাতি হিসেবে বিশ্বের মানুষের সামনে পরিচিত করিয়েছেন। বাঙালির এই অর্জন আজকের পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সামনে একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
বাঙালির প্রতি তাঁর আবেগ ছিলো সীমাহীন, বাঙালিকে কেন্দ্র করে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিলো মৃত্তিকাসংলগ্ন এবং সমুদ্রসমান ভালোবাসা দিয়ে এ জাতিকে গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবার স্বপ্নে তৈরি করেছিলেন নিজের সবটুকু। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, একটি ভাষাগত ও জাতিগত রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে তা এ সময়ের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে যদি অনেক রাষ্ট্রের জন্ম হয় তাহলে আর কোনো বৃহৎ শক্তি থাকবে না। কেউ কারো ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবে না। শান্তি ও কল্যাণের রাষ্ট্র হবে সেগুলো। আগামী দিনের ছেলেমেয়েরা জানবে না বিশ্বযুদ্ধ কী! বাংলাদেশের মতো একটি একটি করে গড়ে উঠবে অসংখ্য রাষ্ট্র।
সেই ভাষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন একটি অলৌকিক বাক্য। তর্জনি তুলে বলেছিলেন, ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ বাক্যটি ভেবে দেখতে হবে। তিনি যদি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতেন তাহলে বলতেন, ‘আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ তিনি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেননি। আঞ্চলিক শব্দ সহযোগে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার হৃদয়ের এ বিশাল দরজা খুলে দিয়েছেন, যে দরজা পথে বেরিয়ে এসেছে বাঙালি চরিত্রের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য।
এই ছোট্ট বাক্যটি সেতুবন্ধ গড়ে তুলেছে এস. ওয়াজেদ আলির একটি দীর্ঘ বাক্যের সঙ্গে, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতিক্ষায় আছে। যিনি তাঁকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন- ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম সুস্পষ্ট করে তুলবেন’। পার্থক্য এই যে, তাঁকে দীর্ঘ অর্থবহ বাক্য রচনা করতে হয়নি, তিনি রচনা করেছেন ছোট অথচ তীক্ষè, অপ্রমিত অথচ গভীর অর্থবহ বাক্য।
৭ই মার্চের ভাষণে সেদিন তিনি সেই বাক্যটির পর বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এই বাক্যটি তিনি প্রমিত বাংলায় বলেছেন। এখানেও এস. ওয়াজেদ আলির আর একটি বাক্যের সঙ্গে সংযোগ-সেতু রচিত হয়। কি আশ্চর্যভাবে এই ভাষণ জাতীয় পটভূমি থেকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছে- মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রতিটি দেশের জন্য সর্বজনীন সত্য। মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম এককভাবে হয় না, এরজন্য প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক সমর্থন, সাহায্য এবং সহযোগিতা। তাই বাক্যটি উচ্চারিত হয় প্রমিত বাংলায়। বাঙালি জাতিসত্তার ঊর্ধ্বে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধনের প্রত্যাশায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম। সেদিনের বক্তৃতায় তাঁর উত্থিত সেই অমিতবিক্রম তর্জনির সঙ্গে কন্ঠস্বর যখন একই সমান্তরালে পৌঁছে যায়, তখনই বাঙালির অভিনব জীবন আস্বাদের স্পৃহা প্রবল হয়ে ওঠে।
এই ভাষণের প্রতিটি বাক্যই বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবে না’ বাক্যটি সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক, অর্থনৈতিক বিষয় স্পষ্ট করে দেয়। এই বাক্যটি দেশের সীমানা অতিক্রম করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের কাছেও পৌঁছে যায়।
এই ভাষণ কী করে দেশের সীমানা অতিক্রম করল এটা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথা। তিনি বলেছেন যে বিদেশে কোনো একটি জায়গায় একজন কাশ্মীরের গেরিলাযোদ্ধার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে, নানা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এভাবে কি আপনারা অন্য দেশের ওপর নির্ভর করে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবেন? সেই গেরিলাযোদ্ধা সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলেছিলো, Are you from Bangladesh?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোট ছোট দেশগুলোর জনগণের কাছে এভাবেই পৌঁছে গেছে। এ পৌঁছে যাওয়া শুধু একটি ঘটনা নয়। এর পিছনে আছে হাজার বছরের একজন মানুষের অভিজ্ঞান নিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসকে নিজের মধ্যে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের প্রাজ্ঞ মনীষী সরদার ফজলুল করিম ৭ই মার্চের ভাষণ শুনেছেন রমনা রেসকোর্সে বসে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিজেকে যত ক্ষুদ্রাবয়ব মনে করি, তেমন আর তখন যথার্থই ছিলাম না। আমার অবয়বকে আমি যথার্থই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। দেহ আমার দীর্ঘ হচ্ছিল। শরীরে আমার রোমাঞ্চ জাগছিল। সাহস বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর তাই পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানগুলো আমার মাথার উপর দিয়ে সগর্জনে যখন আসা-যাওয়া করছিল এবং সে বিমান থেকে যে কোনো মুহূর্তে যে মৃত্যুর বাণ আমর বুকে এসে বিঁধতে পারে, সে কথা জেনেও আমার পা একটুও কাঁপছিল না। আমি ছুটে পালাতে চেষ্টা করিনি।’
ইতিহাসে তিনিই অমর, যিনি সমগ্র জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন- ইতিহাস তাঁরই পক্ষে যিনি সময়ের বিচারে নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারেন। এ সংজ্ঞায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই মহামানব, সময় যাঁকে সৃষ্টি করেনি, যিনি সময়কে নিজের করতলে নিয়ে এসেছেন। যিনি কঠোর স্বরে নিজস্ব ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছিলেন সব কালের উপযোগী এবং সব দেশের জন্য প্রযোজ্য একটি অমর পঙ্ক্তি ‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ রক্ত দেয়া অর্থবহ হয় নিজের জীবন উৎসর্গ করার প্রতিজ্ঞায়। এই প্রতিজ্ঞা মুক্তিকামী মানুষের ঘরে ঘরে উচ্চারিত না হলে মুক্তির লক্ষ্য অনিবার্য হয়ে ওঠে না। ইউনেস্কোর বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছালে এই ভাষণের তীব্রতা অপ্রতিরোদ্ধ হয়ে উঠবে মানুষের চেতনায়। সেজন্য ইউনেস্কোর এই দলিল সংরক্ষণের উদ্দ্যোগ। মানুষের জীবন যেন ন্যায়সঙ্গত সমতার বিচারে মহীয়ান হয়ে চির জাগরুক থাকে বিশ্ব সংস্থার এমন আবেদনই সকলের প্রত্যাশা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষ জীবনে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন : ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। ..... মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-এক দিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।’
যে পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ এই কথাগুলো বলেন, সেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু এই কথাও সবাইকে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি আমাদের যেভাবে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, মানুষ হিসেবে মানুষকে যে আশ্বাসের কথা শোনাতে চেয়েছিলেন, এ দেশে এমন আর কে চেয়েছেন। তিনি পরিষ্কার উচ্চারণে বলেছেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথার একই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশের মানবপীড়ন দেখে যে ক্ষোভ থেকে পরিত্রাণকর্তার আবির্ভাব চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা পূরণ করেছেন অমৃতের সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষায় তাঁর অবদান আজ বিশ্বনন্দিত। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তিনি আজ অমর মানুষ।
লেখক: বাংলা একাডমেরি সভাপতি ও সাহত্যিকি