প্রশাসনের সাহায্যে ক্ষমতার অপব্যবহার চলছে
ভারতের সংবিধানের স্বীকৃত চতুর্থ স্তম্ভ অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সরকারের সমালোচনা করার সবরকম অধিকার আছে। গণতন্ত্র ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার জন্য ২০১৪ সালে দেশের ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, দেশকে বিরোধীশূন্য করা, কংগ্রেসসহ সমস্ত বিরোধী দলকে ঠুটো জগন্নাথ করে রাখা। মোদি যেমন সাড়ে সাত বছরে একটি সাংবাদিক বৈঠকও করেননি, ঠিক তেমনি তাঁর দিদি বঙ্গেশ্বরী মমতা ব্যানার্জিও তাঁরই পথ অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধিতা সম্পুর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সবরকম চেষ্টা করে চলেছেন। প্রশাসনের সাহায্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দমিয়ে রাখতে চাইছেন বিরোধীদের।
২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের একটি পঞ্চায়েতেও মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি। তাঁর পুলিশ প্রশাসন এবং ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ কাজে। আর মাত্র তিন দিন আগে [২৭ ফেব্রুয়ারি]পশ্চিমবঙ্গের ১০৮টি পুরসভার নির্বাচনে বিরোধীদের কোনও কেন্দ্রেই নির্বিঘ্নে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। দূরদর্শনের পর্দায় প্রতি মুহূর্তে এই খবর এবং ছবি দেখানো হয়েছে। সেই সঙ্গে দিদি আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেলের ৯জন সাংবাদিককে পুলিশ ও ঠ্যাঙ্গার বাহিনী দিয়ে প্রচণ্ড মারধর করেছেন। আহত সাংবাদিকদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশংকাজনক। তারা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন। দিদি তার প্রশাসন, তার দল এই ঘটনা নিয়ে টু শব্দটি করেননি। উল্টো তার সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীদের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ করেছেন। বলেছেন, এইসব সাংবাদিকরা নাকি ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের ভোট না দিতে বলেছেন। এই অভিযোগকে মিথ্যা বলে চ্যালেঞ্জ করে এবিপি আনন্দ সহ পত্রিকাগুলি নানাভাবে আসল ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছে। স্পষ্ট দেখানো হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বুম এবং ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙ্গে চুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে জঙ্গলে। এছাড়া বিভিন্ন বুথে ঢুকে ইভিএম রাস্তায় ফেলে দিয়েছে এমন চিত্রও দেখা গেছে। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে নির্বাচনের সময় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী যখন ঘুরছিলেন, তখন দিদি সন্ত্রাসী বাহিনী পিস্তল তাকে ঘেরাও করে রাখে। সেদিন কি কি ঘটেছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী নিচে দেওয়া হলো।
গণতন্ত্রের ধ্বংস কত নির্মমভাবে হতে পারে তার একটি আন্দাজ পাওয়া যাবে এইসব ঘটনার বিবরণ থেকে। তৃণমূলের অন্তর্গত প্রশাসন ও গুন্ডাবাহিনী সকাল থেকেই সন্ত্রাস শুরু করেছিল। সাত সকালেই মেদিনীপুরের কাথিতে আক্রান্ত হয় সংবাদ মাধ্যম। এপিবি আনন্দের এক সাংবাদিককে মারধর করা হয়। উত্তর দমদমের একটি পার্কে সি পি এম প্রার্থীর বুথে গেলে তৃণমূল বহিরাগতরা তাকে মারধর করে। সেই খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হন এক সাংবাদিক এবং এক চিত্র সাংবাদিক।
উত্তর চব্বিশ পরগণার বনগাঁ পুরসভার একটি ওয়ার্ডে বুথ দখল ও ছাপ্পা ভোটের ছবি তুলতে গেলে, স্থানীয় দুটি সংবাদপত্রের এক সাংবাদিক ও এক সম্পাদকের উপর। এছাড়া একই জেলার মধ্যমগ্রাম পুরসভা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার রাজপুর সোনাপুর পুরসভার একাধিক ওয়ার্ডে অশান্তি করে শাসকদলের মদদপুস্ট লোকজন। নিগৃহীত হন সাংবাদিকরা। বোলপুরেও শাসকদলের প্রবল পরাক্রম ছিল ভোটের দিন। জেলাপ্রশাসক, পুলিশ প্রশাসক, মহকুমা শাসক থেকে শুরু করে সকলেই ছিল স্বৈরতান্ত্রিক কাজকর্মের সহায়ক।
দক্ষিণবঙ্গের মতো উত্তরবঙ্গেও গণ্ডগোল করে শাসকদল। জলপাইগুঁড়িতে দুটি কেন্দ্রের দরোজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হন একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রের সাংবাদিক এবং আরও কয়েকজন। একটি দেশের গণতন্ত্র বেঁচে থাকে সরকার ও সুষ্ঠু ভূমিকার উপর। সেখানে যদি বিরোধীদের মুছে দেওয়ার চেস্টা চালায় সরকার তাহলে গণতন্ত্র শুধু খাতা কলমেই থেকে যায়। কেন্দ্রে মোদি সরকার যেভাবে কংগ্রেসমুক্ত ও বিরোধীমুক্ত দেশ গড়তে চাইছেন, পশ্চিমবঙ্গে তার দিদিও সেই একই কাজে নেমেছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মূখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত সরকার রায় বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বঙ্গেশ্বরী মমতা ব্যানার্জিকে এই শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে হিটলারি কায়দায় পাঁচ বছর রাজ্য চালিয়েছিলেন। এখন তার শিক্ষায় শিক্ষিত মমতা দিদি একইভাবে চলছেন। এই কাজে তিনি সহায়তা পাচ্ছেন পুলিশ প্রশাসনের। আর সঙ্গে রয়েছে প্রচুর টাকা। যে টাকা তিনি চাচ্ছেন, উঠতি ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে। এই ব্যবসায়ীরা পশ্চিম বঙ্গের শাসকদলের সাথে নানাভাবে আর্থিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর শাসকদলের অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বে আছেন দিদির যে সৈনিক, তার মাধ্যমেই চলছে এই লেনদেন।
যাইহোক, গায়ের জোরে টাকার জোরে যেভাবে বিরোধী, সংবাদমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে পায়ে দলে ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন, তৃনমূল নেত্রী, তা কখনোই শেষ কথা হতে পারে না। বরং এভাবে চলতে থাকলে খুব শীগগিরই শেষদিন দেখতে হবে অত্যাচারী শাসকদলকে।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক