ভাষার সঠিক চর্চায় দেশের শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব নিতে হবে
১৯৫২ সালে আমার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে চার বছর। বাবার বদলির সুবাদে ছোটচাচা আমাদের সাথেই থাকতেন। আগেরদিন রাতে আমাকে বললেন যে, ভোরবেলা তিনি মিছিলে যাবেন। আমাকে তাঁর কাঁধে তুলে নিলেন এবং আমি তাঁর মাথা ধরে মিছিলে গেলাম। আমাকে ছোট চাচা বলেছিলেন যে, আমি যা বলবো, তুই তাই করবি। ছোট চাচা যখন চিৎকার করে বলতেন, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' আমিও তার সাথে চিৎকার করে বলতাম 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' ছোট চাচা ডান হাত তুলতেন, আমিও ঠিক তাই করতাম। ছোট চাচার সাথে আমি নিজেও বলতাম 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' সেই সুবাদে আমি নিজেও একজন ভাষা সৈনিক। যদিও ইতিহাসে আমার নাম নাই।
২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার ইতিহাসে অত্যন্ত গর্বের দিন। ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো। সারাবিশ্বের মানুষ গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দিনটি উদযাপন করে থাকে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এটি অনেক বড় প্রাপ্তি। একটি দেশের মানুষ ভাষার জন্য লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে। ভাষার প্রশ্নে দেশের তরুণ প্রাণ মাথা নত করেনি। তারা বুকের রক্ত দিয়েছে। যার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলা ভাষার সম্মান। বিশ্বের দরবারে আমরা পেয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি।
তবে দুঃখের কথা, ভাষা আন্দোলনের বয়স এখন ৭০। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কোথাও নাই।মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও নাই। বাঙালি জাতির গৌরবের ইতিহাস দুটি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এ দুটি ইতিহাস সম্পর্কে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা কিছু রেখে যেতে পারছি না এটি খুবই দুঃখজনক। আমার মানসিক বেদনার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে একটি ভাষা প্রতিবন্ধী জাতি। কারণ, আমরা সঠিক ব্যাকরণে বাংলা লিখি না। বাংলা উচ্চারণ করি না। উপরন্তু আমরা ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথা বলি। বাংলিশে কথা বলি। তার মানে হচ্ছে, আমরা দুটি ভাষার একটিও সঠিকভাবে জানিনা। সেজন্য দুটি ভাষায় মিলিয়ে গুলিয়ে কথা বলি। একটু বাংলা একটু ইংরেজিতে আমরা কথা বলি। আমরা ইংরেজি জানিনা। ইংরেজি যে জানিনা তার প্রমাণ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা তিনটি বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ।প্রত্যেকটি বইয়ের প্রত্যেকটি পাতায় ভুল আছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনী অনুদিত হয়েছে [unfinished memoirs] যেমন বঙ্গবন্ধুকে লেখা বইটির প্রথম অধ্যায়ে দেখা যায়, since u r idle, why u don’t write ur memoirs.বাংলা কথাটি ছিল তুমি কোন কাজ করছ না,হাতে কোন কাজ নেই ,তুমি তোমার আত্মজীবনী লিখ। তারপর আরও এক জায়গায় আছে যে, আমরা চারজনে ১৫০ মোঘলতলি অফিস পাহারা দিলাম।we guarded the office 4 by 4. জামাত বানান আমরা সবসময় লিখি, jamaat. এখন সেটি হয়ে আছে, jamat.আমরা ইংরেজিতে বলি language movement আর বাংলায় বলি ভাষা আন্দোলন।ওখানে হয়ে আছে language additation. সেজন্য আমি বলি আমরা বাংলা জানি না, ইংরেজি জানিনা,আমরা ভাষা প্রতিবন্ধী জাতি হয়ে আছি।
আরও একটি কথা যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি হলো কেন?৮ই ফাল্গুন হলো না কেন? ইংরেজিতে প্রকাশ করছি মনের ভাব।২১শে ফেব্রুয়ারি বলছি কিন্তু সেটি হবে ৮ই ফাল্গুন। আমরা এসব অবহেলা করতে পারি না। সবকিছু মিলিয়ে আমরা বাঙালি একটি হযবরল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এত হতাশার ভিতরও আমি আশা ধরে রাখতে চাই। তবে সেক্ষেত্রে কিছু পূর্ব শর্ত আমার আছে। বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার সঠিক চর্চা করতে হবে। এই চর্চা করার জন্য দেশের শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব নিতে হবে। অন্যথা ভাষা শিক্ষা ও ভাষা চর্চা সুসংহত হবে না।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট