দ্রব্যমূল্য: মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস আর গরীবের নাভিশ্বাস
দাম বাড়ছে সব কিছুর কিন্তু আয় বাড়ছে না সাধারণ মানুষের। দাম বাড়ছে খাদ্যপণ্যের, বাড়বে বলে আশংকা আছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির। জীবনযাপনের ব্যয়ের নদীতে নৌকা চালাতে আয়ের লগি তল খুঁজে পাচ্ছে না কোনমতেই। ছুটি গল্পের সেই কথাটি পাঠকদের মনে দাগ কেটেছিল নিশ্চয়ই। নৌকার মাঝিরা সুর করে বলছিল, এক বাও মেলেনা, দুই বাও মেলে না। জীবন নৌকা বাইতে গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ আজ সুর করে নয় বিলাপ করে এই ধরণের কথা বলছেন। রবীন্দ্রনাথ নদীর গভীরতা মাপতে মাঝির মুখের কথা সাহিত্যে তুলে এনেছিলেন আর সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে, আয় ব্যয়ের ফারাক মাপতে যেন এই কথা দুঃখের সঙ্গে বলে যাচ্ছেন প্রতিদিন। তাদের মাস শেষের আয় আর সারা মাসের ব্যয়ের হিসাব মিলছে না যেন কোনোভাবেই।
নতুন বছর এসেছে যতটা সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে তার চেয়ে বেশি জীবন যাপনের উপকরনের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা নিয়ে। গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে নাকাল মানুষের জীবনে আবারও আঘাত আসবে এসবের দাম বাড়ানোর কারণে। বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন দুই চুলার গ্যাসের জন্য দাম দিতে হতো ৪০০ টাকা, পাঁচ দফায় দাম বাড়ানোর পর এখন দিতে হচ্ছে ৯৭৫ টাকা। দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ২১০০ টাকা। বিদ্যুৎপ্রতি ইউনিট দাম দিতে হতো ৩.৭৬ টাকা ১০ বার দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.১৩ টাকা, একটি মাঝারিপরিবারে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে মাসে বিদ্যুতের জন্য খরচ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ টাকা। এখন বলা হচ্ছেএর দাম আরও বাড়বে। ডিজেল প্রতি লিটার ৪৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮০ টাকা। বাসের ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ। উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকা, যাত্রী প্রতি ভাড়া বেড়েছে ১৫০ টাকা, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পণ্য পরিবহণ ব্যয় যারপ্রভাব পড়েছে খাদ্য পণ্যের দামে। ঢাকা নগরে ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকের ঝগড়া ঝাটি লেগেই আছে। পানির দেশ আর চার দিকে পাঁচটি নদী দিয়ে ঘেরা ঢাকা নগরে পানি দুর্মূল্য হয়ে পড়ছে। ২০০৮ সালে প্রতি ইউনিটপানির দাম ছিল ৫.৭৫ টাকা ১৪ বার দাম বাড়ানোর পর এখন তা ১৫.১৮ টাকা। একটি পরিবারে মাসে ১ হাজার ৮০০টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে পানির বিল দিতে। পানির সাথে সমপরিমান বাড়ে সুয়ারেজ বিল। এবার আবারও পানিরদাম বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে ৪০ শতাংশ। চাকরিজীবীদের মাসের শুরুতে বেতন আর মাসের শেষে পকেট মিলছেনা তো কোনভাবেই। শ্রমিক এবং দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের জীবন কেমন চলছে জিজ্ঞেস করলে মলিন হেসে বললেন একজন। কেমন আছি, শুনবেন ? এক গ্লাস পানি খাইতে লাগে ২ টাকা আর সিটি করপোরেশন টয়লেটবানাইছে, সেইখানে প্রস্রাব করতে লাগে ৫ টাকা। বুইঝা লন এবার, আয় আর ব্যায়ের ফারাক কত?
সরকারের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থনীতির অগ্রগতি হচ্ছে, সব সুচকেই ঊর্ধ্বমুখী। সাধারণ মানুষ জীবন দিয়ে বুঝছেন জীবন যাপনের সব ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী। সরকারের দায়িত্ব যেন দাম বাড়ানোকে যুক্তিসঙ্গত বলে সাফাই গাওয়া। ওয়াসারএমডি ১৩ বছরে শুধু ১৪ বার পানির দাম বাড়াননি, তার কাজের দক্ষতার কারণে তার বেতন ভাতাও বেড়েছে ৪২১শতাংশ। এখন তিনি সর্বোচ্চ বেতন ভাতা প্রাপ্ত কর্মকর্তা। তার মাসিক বেতন ভাতা ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তিনি একটা দারুণ কথা বলেছেন। ভর্তুকি দিয়ে পানি দেয়া যাবে না। ভিক্ষা নিয়ে কি কোন প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে? কিন্তু এই কথা কি একবারও ভাবলেন না, যে প্রতিষ্ঠান ভিক্ষা নিয়ে চলে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা আরঅন্যান্য কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা এত বেশি কেন?
আরও পড়ুন: মাথাপিছু আয় বাড়ছে, মানুষ ছুটছে টিসিবি’র ট্রাকের পিছে
শুধু দাম বৃদ্ধি নয় আয় বৃদ্ধির নতুন সুখবর জানানো হয়েছে ইতিমধ্যেই। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নাকি থামছেই না। সর্বশেষ হিসাবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৯১ ডলার অর্থাৎ ৮৭ টাকা ডলারধরলে ২ লাখ ২৫ হাজার ৪১৭ টাকা মাত্র। টাকার পরে মাত্র লিখতে হয়। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয়ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। তারপর মাথাপিছু আয় বেড়েছে আরও ৩২৭ ডলার, হয়েছিল ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। এখনআরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার এবং আরো বাড়বে। করোনায় মানুষ কাজ হারিয়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে কিন্তু মানুষের আয় বেড়ে যাওয়াকে কেউ ঠেকাতে পারে নাই। তবে একটা ব্যাপারও ঘটেছে, মাথাপিছু আয়ের হিসাব শুনেমাথা ঘুরে যাবার উপক্রম হলেও পকেটে হাত দিয়ে মানুষ দেখছে টাকা নেই।
কেমন করে আয় বেড়ে গেলো এতো? এর একটা কারণ সরকার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হিসাব করার জন্যসম্প্রতি নতুন ভিত্তিবছর চূড়ান্ত করেছে। ২০১৫-২০১৬ ভিত্তিবছর ধরে এখন থেকে জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, মাথাপিছু আয় গণনা করা শুরু হয়েছে। এতদিন ২০০৫-২০০৬ ভিত্তিবছর ধরে মাথাপিছু আয় হিসেব করা হতো। ভিত্তি পাল্টানোর ফলে হিসেবে আয় তো বেড়ে গেল কিন্তু বাস্তবে সাধারণ মানুষের আয় কি বেড়েছে? ২০১৫-২০১৬ ভিত্তিবছর ধরে হিসাব করায় আগের কয়েক বছরের মাথাপিছু আয়ও বেড়ে গেছে। যেমন, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। নতুন হিসাবে হয়েছে ১ হাজার ৭৩৭ ডলার। এর পরের প্রতি বছরই মাথাপিছু আয় বেড়েছে। আগের হিসাবে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২৪ ডলার। এখনতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলারে। এই হিসেব অনুযায়ী ৫ সদস্যের একটি পরিবারে এখন মাসিক আয় ৯৩ হাজার টাকার বেশি। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পরিবারের বার্ষিক আয় ১১ লাখ টাকারও বেশি। জিডিপির সাথে রেমিটেন্সযোগ করে দেশের মোট জনসংখ্যা দ্বারা ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন যে ১ কোটি৩৬ লাখ শ্রমজীবী, দেশের অভ্যন্তরে ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমজীবী, ৩ কোটির উপর কর্মক্ষম বেকার, ১ কোটির উপরবৃদ্ধ, ৪ কোটি ছাত্র ছাত্রী কার কার আয় বেড়েছে তার সাথে দেশের গড় আয় বৃদ্ধি কি মিলবে? কিছু মানুষের আয় এত বেড়েছে যে গড় আয় বেড়ে গেছে। হিসেব করে আমাদের দেশের কর্তা ব্যক্তিরা গর্ব করে বলেন, মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ এখন নাকি ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানুষের মাঝে জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করছে না। একদিকে শোষণ অন্যদিকে কোভিডসহ নানা কারণে বৈষম্য বেড়েছে।
কিছুদিন আগে করোনার প্রভাব নিয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চসেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে জানিয়েছিল, দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনা চলমান, কর্মহীনেরা অনেকে কাজ ফিরে পায়নি, করোনার অজুহাতে বেতনকমানো হয়েছে বেসরকারি খাতের কর্মজীবীদের, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের আনার সক্ষমতা বাড়েনি কিন্তুখাবারের জিনিসের দাম বেড়েছে বহুগুণ।
এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ জনজীবনকে স্থবির করে দেবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি কৃষি, পরিবহন, দ্রব্যমূল্য, শিল্পউৎপাদন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, ক্রয় ক্ষমতা কমে, থমকে যায় অর্থনীতির অগ্রযাত্রা। এরই মধ্যে চাল, ডাল, চিনি, তেল, ওষুধসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সংকুচিত হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বড় ধরনের দুর্যোগ দেখা দেবে। মূল্যবৃদ্ধির নিচে চাপা পড়ে হাঁসফাঁস করতে থাকা জনগণের জন্য তা চরম আঘাত হিসেবে দেখা দেবে।
লোকসান হচ্ছে বলে লোকসান কমাতে দাম বৃদ্ধির কোন বিকল্প নাই একথা কথা বলা হলেও, তথ্য বলছে গ্যাস ও বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই লাভজনক। তারাপ্রতি বছর সরকারি কোষাগারে কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা দিচ্ছে। উদ্বৃত্ত অর্থ, ট্যাক্স-ভ্যাট ও বিভিন্ন ফি হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত থেকে আয় করেছে সরকার। লাভ হয়েছে বলে গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসও বাড়ছে ফি বছর। তাহলে দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তেরকারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যয় বাড়ছে দিন দিন। চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হওয়ায় বসিয়েবসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে তথাকথিত উদ্যোক্তা নামের বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নজর না দিয়ে এবং আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ না নিয়ে গ্যাস আমদানিরসুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতেও বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ বাড়ছে। কে দিচ্ছে এই টাকা? টাকা যাচ্ছে জনগণের দেয়া ট্যাক্স থেকে। অদক্ষতা, অনিয়ম আর অব্যস্থাপনা দূর না করে, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা না নিয়ে প্রতিবছর দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ মূলত সরকারের ব্যর্থতার দায় জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার নামান্তর।
সংকট জিইয়ে রাখলে দাম বাড়ানোর অজুহাত শক্তিশালী হয়। এভাবেই গ্যাস সংকট জিইয়ে রেখে এলএনজি ব্যবসার দ্বার খোলা হয়েছিল এখন তা লুণ্ঠন ও দাম বাড়ানোর মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। জনগণ হয়েছে সুন্দর এবং অসহায় হরিণের মত। সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভরছেন। এটা স্পষ্ট যে, গ্যাস, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, পানি সকল খাতের লোকসান আসলে দুর্নীতির ফল। কিন্তু এর দায় নিচ্ছে না সরকার বরংসকল দায়িত্ব জনগণের চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বৃদ্ধি, জীবন যাপনের কষ্ট বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এই করোনা মহামারী সব কিছুকে শ্লথ করে দিলেও নতুন কোটিপতি বৃদ্ধিরগতিকে থামাতে পারছে না। করোনাকালেও নতুন কোটিপতি বেড়েছে ১৭ হাজারের বেশি। ধনীদের ধন বৃদ্ধি আর সাধারণ মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি যেন সমানতালেই বাড়ছে। তাহলে কার চোখে দেখবো মূল্য বৃদ্ধির অভিঘাতকে? ধনীদের চোখে সামান্য মূল্যবৃদ্ধি যে সাধারণ মানুষের জীবনে প্রচণ্ড আঘাত সেটা বুঝার মন আর আঘাত দুর করার উদ্যোগ কি আছে নীতিনির্ধারকদের?
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)