বাংলাদেশ এক উদীয়মান বাঘ
এশিয়ার দুই বৃহত্তর শক্তি চীন ও ভারতের সার্বক্ষণিক দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশকে কব্জায় রাখতে উভয় দেশই বেশ তৎপর রয়েছে। কোনো দেশই বাংলাদেশকে হাতছাড়া করতে চায় না। হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে কখনো কখনো উভয় দেশকেই অতি তৎপর হতে দেখা যায়। আবার এই তৎপরতায় ছন্দপতন ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ সরব হতে দেখা যায়। ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও নানাভাবে বাংলাদেশকে নিয়ে হিসাব কষছে। বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে; কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে শক্তিধর দেশগুলোর এত আগ্রহ কেন? নিশ্চয়ই এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে।
ভূরাজনৈতিক অবস্থানগত কারণেই বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে কিংবা ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে চিন্তাও করা যায় না। এ বিষয়টি নিয়ে ইউএন-এসকাপ নানা পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিগত এক দশকে অনেক কাজ এগিয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক যোগাযোগের এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এশিয়া ও ইউরোপ এক সুতায় গাথা সম্ভব হবে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম নৌবন্দর ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিপুল বাণিজ্য সুবিধা লাভ করতে পারে। এর আগে বেশ কয়েকবার নেপাল ও ভুটান তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রাম বন্দব ব্যবহার করেছে। তাতে তারা দেখেছে, কলকাতা বন্দরের চেয়ে কম খরচে পণ্য পরিবহন পড়ছে। তাই এই দুই দেশের সরকার চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা চেয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর একটা বড় সুযোগ এনে দেবে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগ থেকেই ভূরাজনৈতিক কারণে বিশেষ করে চীনের উপর নজরদারি বাড়াতে বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল। নানা সময় নানাভাবে চাপও দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সম্মত হয়নি। এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সেই চাপ অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের গ্যাস রপ্তানির ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে আসছিল। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্যাস রপ্তানির ব্যাপারে চাপ দিয়েছিলেন; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন অত্যন্ত সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন। এ কারণেই বাংলাদেশ বড় বিপদ থেকে রক্ষা পায়।
বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে বলেই দেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেলসহ কমপক্ষ দশটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর আগে আমরা দেখেছি, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সরকারের নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হয় বন্ধ অথবা স্থগিত হয়ে যায়। থমকে যায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। আসলে সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকার তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে দীর্ঘমেয়াদি অনেক প্রকল্প হাতে নিতে পেরেছে। পদ্মা সেতু, মেট্ট্রোরেল এবং কর্ণফুলি টানেল প্রকল্প শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে এই তিনটি প্রকল্পের কাজই শেষ হয়ে যাবে। যা দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার ‘ইমার্জিং টাইগার’ বা উদীয়মান বাঘ। এই স্বীকৃতির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিগত দুই বছর করোনা মহামারির ধকল সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটি। যদিও বিগত দুই বছরে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। দারিদ্র বেড়েছে। বেকার সমস্যা প্রকট হয়েছে। অর্থনীতির চাকা থমকে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও কিছু মানুষ ধারা করেছিল, দেশে মারাত্মক খাদ্য সংকট তৈরি হবে। বেকার সমস্যা প্রকট হবে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু এর কোনোটাই ঘটেনি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের চলমান গতিশীল অর্থনীতির মূলে নানাবিধ কারণ রয়েছে। টানা কয়েক বছর বাম্পার ফসল উৎপাদন হয়েছে। ধীরে ধীরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে এগিয়ে চলছে। আপাতত খাদ্য সংকট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। দেশের আপামর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। মঙ্গা নামক শব্দটি বাংলাদেশের ডিকশনারি থেকে প্রায় উঠে গেছে। না খেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা এখন আর ঘটছে না। করোনার কারণে অনেক দেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। দারিদ্রের থাবায় বেশ কিছু দেশ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
করোনায় রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তৈরি পোশাক রপ্তানি কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। স্বস্তি দিয়েছে বৈদেশিক আয় বা রেমিটেন্স। তা ছাড়া দেশের বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো করোনার মধ্যেও চলমান ছিল। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, মাতারবাড়ি কয়লাখনি প্রকল্পসহ অন্তত ১০টি প্রকল্পে কয়েক লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পদ্মা সেতু চলতি বছরের জুনে সম্পন্ন হওয়ার কথা। এটি সম্পন্ন হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় দেড় শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন, ২০০৮ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। শুরুতে সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তবে মাঝনদীতে এসে তরী ডুবানোর মতো অবস্থা সৃষ্টি করল বিশ্বব্যাংক। তখনো প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে বৈঠক চলছিল। নানা প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করল, তারা পদ্মা সেতুতে ঋণ দেবে না। কারণ, তখনকার সেতু মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন নাকি ঘুষ গ্রহণের ‘ইনটেনশন’ পেয়েছে তারা। তখনো কিন্তু বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য কোনো অর্থছাড় করেনি। দেশের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আমলে নিয়েছিলেন। তিনি সেতুমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেতু বিভাগের সচিবকেও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাতে সরকার এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছিল।
তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেন বলে বীরোচিত ঘোষণা দিলেন তিনি। তার সেই সাহসী ঘোষণায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের কিছু প্রতিনিধি বিদ্রুপের হাসি হেসেছিল। তারা বলেছিল, বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়; কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন শেখ হাসিনা। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই সেদিনের স্বপ্ন আজ বাস্তব হয়েছে। করোনার মতো মহামারিকে রুখে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। দেশের এই উন্নয়ন অভিযাত্রা আগামী দশ বছর অব্যাহত থাকলে সিঙ্গাপুর-মালেয়েশিয়ার চেয়েও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। তখন আর বাংলাদেশকে শ্রমিক হিসেবে কাউকে বিদেশে পাঠাতে হবে না। দেশেই আরও শিল্পায়ন হবে। অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন ঘটবে। বিগত ৫০ বছর ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। তাতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেড় দুই শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তখন বিশ্ববাসী সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ নামক উদীয়মান বাঘের গর্জন শুনতে পাবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ ও সাহিত্যিক
সৌজন্যে: ভোরের কাগজ
এসএ/