হঠাৎ দেখা আলকুশি

খাগড়াছড়ি শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান আলুটিলায় কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা উপরে উঠে এলাম। এখান থেকে গোটা শহরের চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়। তারপর খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উল্টোদিকের পাহাড়ে চড়লাম আলুটিলা নবগ্রহ আলোক ধাতুছৈত্য স্থাপনাটি দেখতে। নেমে এসে পথের ধারে বুনো ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে খানিকটা পথ হেঁটে পাহাড়ি কাশফুলের একটি ঝোপের পাশে দাঁড়ালাম। এদিকটা বেশ খোলামেলা। কাশফুলের শক্ত ডাঁটিবেয়ে ওঠা একটি লতা দেখে কিছুটা কৌতূহল হলো। পাতা দেখে মনে হলো কোনো বুনো শিমের লতা হবে হয়ত। কিন্তু মাটিতে গড়ান লতায় অদ্ভূত ফুলটি দেখে সে ইচ্ছা দমে গেল। কারণ শিমফুল সাধারণত এমন হয় না। এমন ফুল আগে কখনো দেখিনি। ঝোপের ভেতরে আরো কয়েক থোকা ফুল ঝুলে আছে। অনেকটা দেশি মাদারের ফুলের মতো কালচে বেগুনি রঙের। পাপড়ির আগা পাখির ঠোঁটের মতো। ঢাকায় ফিরে গাছটিকে আলকুশি হিসেবে শনাক্ত করি। সংস্কৃত নাম আত্মগুপ্তা। বৈজ্ঞানিক নাম Mucuna pruriens। ইংরেজি নাম ভেলভেট বিন। আমাদের বন-পাহাড়ে এখনো মোটামুটি সহজলভ্য। একসময় আমাদের লোকালয়ের ঝোপজঙ্গলে অঢেল ছিল, এখন নেই বললেই চলে। বছর দুয়েক আগে শেরপুরের গজনী অরণ্যে এর ফল দেখার সুযোগ হলো।
আলকুশি ওষুধি গাছ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই বেশ আদৃত। রাজনিঘন্টুতেও এগাছের উল্লেখ আছে।
আলকুশি সাধারণত বর্ষজীবী লতা, কখনো কখনো বহুবর্ষজীবী হতে পারে। প্রতি একবছরে ১৫ মিটারের মতো লম্বা হয়। লতা ও পাতা শিমগাছের মতো। পত্রিকা প্রায় সাড়ে বারো মিমি লম্বা। কমবয়সী গাছ রোমশ। মঞ্জরিদণ্ড আড়াই থেকে ৫ মিমি লম্বা। ফুল ঈষৎ বেগুনি, কোনো কোনো প্রজাতি সাদা কিংবা গোলাপি রঙের। শুঁটি ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা, একটু বাঁকা। ফল লম্বাটে, মাথার দিকে বাঁকানো, রোমশ ও ধূসর রঙের। গায়ে লাগলে ফুলে ওঠে ও চুলকায়। এই কুখ্যাতির জন্য গ্রামের মানুষ খুব একটা কাছে ভিড়ত না। ৬-৭টি বীজ থাকে শুঁটিতে, ধূসর রঙ, কোনোটি কালো। শুঁটি দেখতে শাকআলুর শুঁটির মতো কিন্তু গোলাকার। বীজ চ্যাপ্টা ও ঈষৎ পীতরঙের, মুখ কালো। প্রতিটি বীজ ৫৫ থেকে ৮৫ গ্রাম ওজন হয়। সারা বছরই পর্যায়ক্রমে ফুল ও ফল পাওয়া যায়।
ড. কালীপদ বিশ্বাস ভারতীয় বনৌষধি গ্রন্থে এগাছের অসংখ্য কার্যকর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। গাছের স্বাদুরস বায়ু ও ক্ষয়নাশক, রক্তদোষ ও ব্রণনাশক। বীজ ভেঙে মাশকলাইয়ের সঙ্গে শরবত বানিয়ে খেলে শারীরিক স্বক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া গাছের বীজ, শাক ও মূল বাত, জ্বর এবং কৃমি প্রতিরোধে কার্যকর। বিছার কামড়ে বীজগুঁড়া লাগালে কাজ হয়। এগাছ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে উৎকৃষ্ট পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য। ফল একসময় কফির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
লেখক: প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক তরুপল্লব
