সমন্বয়ের মাধ্যমেই হতাশা কাটিয়ে উঠা সম্ভব
প্রায় তিন বছর ধরে দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রেই একটি অস্থিরতা বিরাজমান দেখা যায়। এমনকি অনেকদিন বন্ধ থাকার পর যখন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলছিল তখন আবার অমিক্রন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি অবশ্যই একটি বড় ক্ষতি। আর এই ক্ষতি কোনোভাবেই আর্থিকভাবে মুল্যায়ন করা যাবে না।
তবে আশার কথা হলো–বিশ্বের সব দেশই এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সংক্ষিপ্ত পাঠক্রম, অতিরিক্ত ক্লাস অথবা পরীক্ষা নেওয়াসহ ইত্যাদি নানাবিধ কার্যক্রমের মাধমে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে সময় চলে যায় সেটি তো আর ফিরে আসবে না। কাজেই সেই সময়ের ক্ষতিটুকু মোকাবিলা করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখন যদি সুসময় আসে এবং তখন যে ছুটিগুলো আছে যেমন–সাপ্তাহিক ছুটি, রমজানের ছুটি–এগুলো কমিয়ে আনা যায়; সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা, বিশেষভাবে অনলাইনে বেশি করে ক্লাস নেওয়া–এসব প্রক্রিয়া সমানভাবে আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। আমি আশাবাদী যে, এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো।
আমি মনে করি, এখন সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সুসমন্বয়। এই সমন্বয় করার মানুষ আছে কি না। সমাজে কারা সমন্বয় করতে পারে, তাদের ডেকে এনে দায়িত্ব দিয়ে বসানোর দরকার আছে। একটি পরিকল্পনার সঙ্গে আরেকটি পরিকল্পনা সাধন করার দরকার আছে। সেই জায়গায় আমরা অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি। সবক্ষেত্রেই দেখা যায়, এ ধরনের মানুষের সংখ্যা অনেক কম যারা সমন্বয় করতে পারে। তাদের বাছাই করে উপযুক্ত জায়গায় বসানো সরকারের দায়িত্ব, সমাজের দায়িত্ব। আমরা গণপ্রশাসনে একটি কথা সবসময় বলে থাকি–রাইট ম্যান ইন দ্য রাইট প্লেস। সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় বসানো। সেই জায়গাগুলোতে আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার দরকার আছে।
আমদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। এই সংকট আরও বেড়ে গেছে এই করোনা মহামারির সময়। এই সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আর্থিক-সামাজিক সর্বক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের এই সীমিত সম্পদ দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। সেগুলোর কাজ চলছে। সেখানে যারা কাজ করছেন, করোনাকালে তারাও মানসিক, শারীরিক, আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এসবের মাঝেই একটি সুন্দর সমন্বয় দরকার। এটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ।
এটি একটি বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়। এই সমস্যাটি যে শুধু আমাদের দেশেই হয়েছে তা নয়, সারা বিশ্বেই এই বিপর্যয় নেমে এসেছে। এই বিপর্যয় যদি রোধ করতে হয়, তাহলে গোটা বিশ্বকেই ঐক্যবদ্ধভাবে রোধ করতে হবে। পৃথিবীতে প্রায় ৭৮০ কোটি মানুষ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ কোটির বেশি মানুষ এখন পর্যন্ত এক ডোজ টিকাও নিতে পারেনি। যে কারণে করোনার একটির পর একটি নতুন ধরন বের হচ্ছে। যদি সব মানুষকে একসঙ্গে টিকার আওতায় আনা যেত, তাহলে নতুন ধরন বের হওয়ার সম্ভাবনা থাকত না। এগুলো মানুষকে হতাশ করে। যারা এখনও টিকা পায়নি বা টিকার আওতায় আসতে পারেনি। এটি তো তাদের হতাশার একটি বড় কারণ।
অনেকেরই কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দিয়েছে, খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। তারা কাজ পাচ্ছেন না। হতাশ হয়ে পড়েছেন এবং হতাশা থেকেই একসময় আসে বিষন্নতা। আমরা দেখেছি, এই বিষন্নতা যদি একবার পেয়ে বসে, তখন মানুষ নিজেকে আত্মহননের পথে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে এবং সারা বিশ্বের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, করোনাকালে আত্নহননের প্রবণতা বেড়েছে। যে কারণে এসব বিষয় সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ। নবীনরা অপেক্ষাকৃত বেশি হতাশ হয়ে যায়। প্রবীণদের হতাশা আসে। সেটি অপেক্ষাকৃত কম। তারা যেন কোনোভাবেই হতাশাগ্রস্থ না হন, তাদের জন্য পরামর্শ দেওয়া, কনসালটেশন দেওয়া জরুরি।
করোনায় শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিকভাবেও তরুণরা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে, অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তাদের উৎসাহিত করা, তাদের পুনঃকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। তাদের কাজে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া দরকার। এজন্যই সমন্বয় দরকার। সমন্বয়ের মাধমেই কিন্তু আমাদের তরুণ সমাজসহ মানুষের মাঝে হতাশা কাটিয়ে উঠা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/