শ্রমবাজারে উৎপাদনশীলতা হবে আমাদের শক্তি
বাংলাদেশের শ্রমশক্তির দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখবো তার বেশিরভাগই তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায় প্রায় ৯০% শ্রমজীবী মানুষ কিন্তু ইনফরমাল মার্কেটে কাজ করে। যারা এই ইনফরমাল মার্কেটে কাজ করে তারা কিন্তু জীবন মৃত্যুর গ্যারান্টি নিয়ে কাজ করে না। তারা কাজ করলে খাবে আর কাজ না করলে উপোস করবে।
চলমান কোভিডকালীন সময়ে আমরা কিন্তু দেখেছি প্রচুর সংখ্যক জনগোষ্ঠীর আয় রোজগার কমে যাওয়াতে তারা কিন্তু পুনরায় দরিদ্র সীমার উপর থেকে নীচে নেমে গিয়েছে। বিভিন্ন গবেষণাতেও কিন্তু তথ্যগুলি উঠে এসেছে। কাজেই আমরা যখন একটি দেশকে উন্নত বলি, তখন সকল মানুষের উন্নতি যদি না ঘটে,কিছু মানুষের উন্নতি দিয়ে, শুধু কাঠামো দিয়ে কিন্তু আমরা একটি দেশকে উন্নয়নশীল দেশ বা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ বলতে পারি না। বাংলাদেশের জন্য এই বিষয়টির বাড়তি গুরুত্ব আছে। কারণ বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে, এই দেশের সম্পদ বলতে একমাত্র মানব সম্পদই আছে। কাজেই প্রতিটি মানুষ যখন সম্পদে রুপান্তরিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারছি বলা যাবে না। তাই যদি হয়, তাহলে আমার উন্নয়নের গল্পটি টেকসই হচ্ছে না। উন্নয়নের গল্পটি সার্বজনীনতা পাচ্ছে না। আমাদের উন্নয়নের গল্পটি সকলের অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে না। কাজেই টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক সার্বজনীন উন্নয়নের গল্প যদি বলেন, তাহলে নারী শিশু থেকে শুরু করে সর্বস্তরে পিছিয়ে পড়া মানুষের এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কিছু মানুষের সুবিধা দিয়ে আমরা কিন্তু টেকসই অর্থনীতির যাত্রা সুনিশ্চিত করতে পারছি না।
শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সেটি ঠিক আছে। সেটি যথেষ্ট বা আমাদের আগামীদিনের অর্থনীতিকে চালিয়ে নিবে বা শক্তি যোগাবে সেই নিশ্চয়তাটুকু কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। বিশেষ করে যখন বিশ্ব অর্থনীতি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে তখনই আমি মনে করি আমাদের দেশের মতো দেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়। ৫০বছর যখন পালন করছি, বিজয় দিবস বলুন, স্বাধীনতা দিবস বলুন, সেখানে অর্জনের পাশাপাশি ঘাটতিগুলি কি আছে, তার একটি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আমরা করে ফেলতে পারি,এবং কোন ধরনের ব্যাখ্যায় না গিয়ে রাস্ট্র এবং বস্তুনিষ্ঠ কল্যাণে তা নির্ণয় করতে পারি। তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরের একটা রোডম্যাপ বা একটি পথরেখা তৈরি করা সম্ভব। তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছর পরে হয়তো উন্নত বাংলাদেশের একটি চেহারা আমরা দেখতে পাবো।
এবার পথরেখায় কয়েকটি বিষয় আসতে পারে। যেমন, আমাদের মানব সম্পদ উন্নয়নের দিকে বিশেষ করে মনোযোগী হতে হবে। আমাদের শিক্ষা কাঠামো, আমাদের দক্ষতা কাঠামো, আমাদের নীতি কাঠামো, মানব সম্পদ বিষয়ক এই সবগুলি বিষয়ের প্রতি যদি আমি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে না পারি, তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরে যে উন্নত দেশের সপ্ন আমরা দেখি সেটি সফল হবে না। কাজেই মানুষগুলিকে সম্পদে রূপান্তরিত করা সেটি শিক্ষার মাধ্যমে, চিকিৎসার মাধ্যমে, অর্থনীতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান সুযোগ তৈরির মাধ্যমে আমি বলবো যে, আমার যাত্রার প্রাথমিক পর্যায়টি আমরা সফলভাবে তৈরি করে নিতে পারবো। দ্বিতীয় যে বিষয়টি, গত পঞ্চাশ বছরে আমরা শুধু পেয়েছি। পৃথিবী তার দরোজা খুলে দিয়েছে, তাদের জন্য আমাদের দরোজা খোলার কোন চাপ ছিল না।কারণ, স্বল্প উন্নত দেশ হিসেবে একপাক্ষিকভাবেই আমরা সুযোগ সুবিধাগুলি পেয়েছি। ২০২৬সালে গিয়ে এই সুবিধাটি চলে যাবে। স্বল্প উন্নত দেশ হিসেবে একপাক্ষিকভাবে যে সুবিধাগুলি আমরা পেতাম সেটি আর পাওয়া যাবে না। বানিজ্যের ক্ষেত্রে, রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে যাবতীয় বাজারের ক্ষেত্রে আপনাকে প্রতিযোগিতায় যেতে হবে। তখন নিতে হবে এবং দিতে হবে। কেউ আমাদের চ্যারিটি করবে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চ্যারিটির ব্যবস্থা নেই। সেখান থেকেই আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে। যে কারণে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডের জাতীয় উৎপাদন আমাদের থেকে অনেক উপরে। যখন আমরা খোলা বাজারে প্রতিদ্বন্দিতা করতে যাই, তখন কিন্তু কিছু মানুষের সুবিধা দিয়ে আমরা কিন্তু টেকসই অর্থনীতির যাত্রা সুনিশ্চিত করতে পারছি না।
সেখানে উৎপাদনশীলতা যদি আমাদের কম থাকে তাহলে আমাদের প্রতিদ্বন্দিতা ক্ষমতা কম থাকবে। সেক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সেজন্য আমাদের শিক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে, দক্ষতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে, নীতি সাহায্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং সকলকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ মেধা ভিত্তিক একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে এবং মেধাবীদের সুযোগ করে দিতে হবে। সকলক্ষেত্রে মেধা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। কারণ উৎপাদনশীলতা বাড়লো কি কমলো সেটি আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে এবং খোলা বাজারে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেটি সরকার নাগরিক সমাজ জনগণ সকলে মিলে সম্মিলিতভাবে প্রতিযোগিতার বাজারটি সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই কেবল প্রতিযোগিতার বিশ্ববাজারে টিকে থাকা সম্ভব।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত