পিএম কেয়ার ফান্ড নিয়ে মোদির ‘লুকোচুরি’
একটা সরকার আর তার প্রধানমন্ত্রী কি শুধুই মিথ্যে কথার উপরে দাঁড়িয়ে আছে? করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে পিএম কেয়ার ফান্ডের টাকা খরচ নিয়েও মিথ্যা কথা বলেছিল খোদ পিএমও, মানে প্রধানমন্ত্রীর অফিস। ভ্যাকসিন আবিস্কার বা তৈরির জন্য পিএম কেয়ার ফান্ড থেকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে বলে রীতিমত প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত এক টাকাও দেওয়া হয়নি। লোকেশ বাত্রা নামে এক সমাজকর্মীর করা আরটিআই (তথ্য জানার অধিকার) থেকেই এই সত্যি প্রকাশে এসেছে। খবরটি ডিজিটাল পোর্টাল দ্য ওয়ারে প্রকাশিত হয়েছে।
কারোনা মহামারীর প্রথম ঢেউ এর সময়ে স্বাধীনতার সময় থেকে চলা প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে মোদি তার নেতৃতে পি এম কেয়ার ফান্ড গঠন করেন। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতামনও সদলা ছিলেন। যদিও এটা সরকারি তহবিল নয়। কিন্তু বিভিন্ন শিল্পসংস্থা ৩ উদ্যোগপতি এই তহবিলে কোটি কোটি টাকা দেন! রেল থেকে ব্যাংক বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মীদের মাইনে থেকে কেটে বাধ্যতামূলকভবে টাকা নেওয়া হয়! কত টাকা উঠেছে আজ পর্যন্ত মোদি তা জানাননি। হিসেবও দেননি।
২০২০ সালের ১৩ মে পিএমও থেকে এক প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, কোভিড ১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার তিন হাজার একশ কোটি টাকা দেবে। যেমন, অন্যদেশের সরকারও দিয়েছে। আর ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য পি এম কেয়ার ফান্ড থেকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। যা সরাসরি জনগণের দানের টাকা। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এই টাকা দেশের প্রধান বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা বিজয় রাঘবনের নজরদারিতে দেওয়া হবে।
সেই টাকা দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চেয়ে ২০২১ এর ১৬ জুলাই আরটিআই করেন বাত্রা। তাকে নানা ভাবে হেনস্তা করা হয় ও বারবার বলা হয় পিএম কেয়ার ফান্ড যেহেতু সরকারি ফান্ড যেহেতু সরকারি ফান্ড নয় সেই ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। অবশেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে জানানো হয়,ভ্যাকসিন তৈরির জন্য পিএম কেয়ার ফান্ড থেকে কোনও টাকাই দেওয়া হয়নি!
"সব কা সাথ,সব কা বিকাশ”
আওয়াজ তুলে নারেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার সময়ে বিকাশ সব থেকে বেশি বেশি হয়েছে গৌতম আদানির। এই করোনা অতিমারির ২০২০ সালে আদানির সম্পত্তি যা ছিল ৬৬ লাখ কোটি টাকা। ২০২১ সালের শেষে তা সাড়ে সাত গুণ বেড়েছে। মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি বৃদ্ধি এর পরেই। কিন্তু অনেক কম।
পশ্চিমবঙ্গে দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার বা সমীক ভট্টাচার্য এর মতো বিজেপির নেতা বা পাড়ার বিজেপি কর্মীদের জিজ্ঞাসা করলেই হতাশা টের পাওয়া যাবে। মোদিজি কার বিকাশ করছেন?এই সময়ে অর্থাৎ ২০২০ থেকে ২০২১ সালে দেশের ২০ কোটি মানুষ আরও গরিব হয়ে গিয়েছে। দেশের কয়েক কোটি মানুষকে রেশনে দুই কেজি করে চাল গম দেওয়া হচ্ছে। যাতে তারা একেবারে না খেতে পেয়ে, মরে না যায়। কিন্তু এই এক বছরে ভারতে এর সংখ্যা বেড়েছে আরও ৪০জন। ভারতের একাধিক বিমানবন্দরও রেল স্টেশন। বেসরকারি করণের নামে তুলে দেওয়া হয়েছে এই মোদিপন্থী শিল্পপতিদের হাতে।
সম্প্রতি মোদি ওয়ার্ল্ড ইকনমি ফোরামে টেলিপ্রমটারে দেখে তার ভাষণে বলছেন, ভারতে বিনিয়োগের এটাই সেরা সময়। ঠিকই বলছেন! এটাই মোদিমিক্স। অর্থাৎ মোদির অর্থশাস্ত্র। গৌতম আদানিও মোদির প্রশংসা করে ঠিকই বলেছেন, মোদির দেখানো পথে দেশ এগিয়ে চলেছে। আসলে মিথ্যা প্রচারের উপর নির্ভর করা ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের হাত ধরা ক্রনি ক্যাপিটাল একসঙ্গে চলে। ইউরোপের ইতিহাস তাই বলে। ভারতেও তাই হচ্ছে। ভারতের নাগরিকরা কি করবেন তা তাঁদেরই ভাবতে হবে। এর সঙ্গে কালীঘাটের ব্যানার্জি পরিবারের ৪০টি বাড়ির ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ওটা কিন্তু ফ্যাসিজিম নয়!
কোনো দেশে ফ্যাসিবাদ একা আসে না। হিটলার বা মুসোলিনির মত রাস্ট্রবাদের কথা বলে ক্রমাগত কিছু মানুষকে ধর্মীয় বা বা জাতিগত বিচারে টার্গেট বানানো একজন ডিক্টেটর একা দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করতে পারে না। তার জন্য দিন রাত ২৪ ঘণ্টা ওই নেতা ও তার মিথ্যা প্রচারকে, ঘৃণার বার্তাকে সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়ার জন্য প্রচার যন্ত্র। হিটলারের জার্মানি বা মুসোলিনির ইতালিতে সেই কাজ করেছিল দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্র ও সরকারি রেডিও। বেশি কিছু পড়তে হবে না। হাতের কাছে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস' বইটি থাকলে বা জোগাড় করে পড়ে দেখতে পারেন।
ভারতে সেই কাজ করছে দিল্লি ও নয়ডার বিভিন্ন মিডিয়া হাউজ। এরাই মালিক হিন্দি ও ইংরেজি সংবাদপত্রও সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলির। প্রচারের জন্য দেদারসে সরকারি অর্থও বিজ্ঞাপন পাচ্ছে তারা। মুনাফা বাড়ছে। উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট এগিয়ে আসায় এদের মুখোশ খুলে গিয়েছে পুরোপুরি।
দিল্লির টাইমস নাও এর নতুন হিন্দি চ্যানেল টাইমস নবভারতের সাংবাদিক তিলক কাটা সুশান্ত সিনহা। রোজ রাতে প্রাইম টাইমে 'রাজনীতির পাঠশালা' নামে এক অনুষ্ঠান করেন। একটাই কাজ, মোদি ও বিজেপির গুনকীর্তন প্রচার এবং কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীকে গালাগালি। দিল্লির যেসব প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক মোদি জমানায় বাধ্য হয়ে ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন,তাদেরও গালাগালি করতে ছাড়েন না। যে কেউ ইচ্ছে ওঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে গিয়ে দেখতে পারেন। টাইমস এর মালিক জৈনরা পুরোপুরি মোদীর সমর্থক ও ভক্ত। তাদের কাগজের কলকাতার এডিশনেও এই মহান সাংবাদিকের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন বার হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি থেকে বেকারি বা দেশের আর্থিক অবস্থা এমনকি চার্চ ভাংচুর এই সব বিষয় কিন্তু সুশান্তের পাঠশালায় পড়ানো হয় না।
অন্য ছবিটি মুকেশ আম্বানির চ্যানেলের হিন্দির এডিটর আমন চোপড়ার। ইনিও তিলকধারী এবং প্রাইম-টাইম শো, করেন রোজ রাতে।এরও কাজ ওই একই মোদীর প্রচার এবং রাহুল গান্ধীকে উপহাস করা। যেমন-হিন্দুত্ববাদী শব্দ, যা রাহুল জয়পুরের ভাষণে বলেছিল। রামদেব এর সফরসঙ্গী হয়ে তার মুখ দিয়ে রাহুলকে খিল্লি করে 'বাওড়া' বলানোর কাজটি এই অমন করেছিলেন। দুই দিন আগে রায়পুরের এক ধর্মসম্মেলনে সাধুবেশী কালীচরণ মহাত্না গান্ধীকে গালাগালি দিয়ে বলেছিল, ওকে হত্যা করার জন্য নাথুরাম গেডসে্কে প্রণাম।
সেই কালীচরণকে পরের দিন টিভিতে বসিয়ে আমনের কি কাকুতি মিনতি। মহারাজ একবার বলুন ভুল হয়ে গিয়েছে। আপনার জন্য গোটা হিন্দুদের অসম্মান করে সমালোচনা করছে সেকুলাররা। ওরা বলার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। কালীচরণের মত পাষণ্ড তো কথাটি বলে বিরাট মজা পেয়েছে। কারণ, দেশ জুড়ে প্রচুর প্রচার পেয়েছে। সবাই ওর নাম জেনে গিয়েছে। ওই কথার পরেই সে বলেছিল, এখনই বিজেপির উচিত সংবিধান বদলে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করা। তা নিয়ে কিন্তু তিলক কাটা সাংবাদিক কিছু বলছে না। উল্টে বলছে আপনার একার জন্য হিন্দুত্ববাদী মানে হিন্দুদের নিয়ে অপপ্রচার হচ্ছে। মোদিজিও গান্ধীকে ফুল দেন।
আমন চোপড়া এতটাই অশিক্ষিত যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে মোহনদাস গান্ধীজিকে মহাত্না গান্ধী বলেছিলেন, তা-ও জানে না। গুজরাটের কোন একটি হিন্দু সাধুর নাম করে বললো এখন অন্য সাধুদের কি মত তা নিয়ে আলোচনা করবো। প্যানেলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা আরও গেরুয়াধারীদের নিয়ে আলোচনা শুরু হলো।
কেন এফ আই আর হওয়ার পরেও কালাচরণকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তিলককাটা আমনের মতো সাংবাদিকরা একটাও প্রশ্ন করে না।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক