সাধারণতন্ত্র দিবস ও নেতাজির ট্যাবলো বিতর্ক
২৬ জানুয়ারি ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবসের ৭২ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে ভারতে সংবিধান রচনার কাজ শেষ হয়। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সংবিধানে স্বাক্ষর করার পর ঘোষণা করেছিলেন, পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হবে। তিনি সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে বলেছিলেন, ২৬ জানুয়ারি ভারত স্বাধীন হবে। সেদিনই হবে স্বাধীনতা দিবস। তবে মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিল, আর বেশিদিন এ দেশে রাজত্ব করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারা ভারতকে ভাগ করে এদেশ থেকে চলে গেল।
যা-ইহোক এরপর থেকে নেতাজির ইচ্ছে অনুযায়ী, ২৬ জানুয়ারিতে ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবস পালিত হয়। ১৯৫০ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছর এই দিনটিতে একজন করে বিদেশি রাষ্ট্রনেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই রীতি বরাবরই চলে আসছে। গত বছর করোনা আবহের মধ্যেও এই রীতি লঙ্ঘিত হয়নি। যথারীতি ২৬ জানুয়ারির অনুষ্ঠানে আনা হয়েছিল এক বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে। কয়েকমাস আগে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে কথা হয়েছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে এবারের সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে। তবে সাউথ ব্লকের সরকারি ব্যাখ্যা হলো–করোনা অমিক্রন আবহে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না।
প্রায় ৩ সপ্তাহ আগে উত্তরাখণ্ডের রাজধানী হরিদ্বারে গেরুয়াধারী তথাকথিত সাধু-সন্তরা একের পর এক প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে গিয়ে বলেন, ভারতের মুসলমানদের গুলি করে মারা হবে। মারা হবে শিখদেরও। সাধুদের এই সভায় সাম্প্রদায়িক উক্তি নিয়ে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীসহ সব বিরোধী দল ওই সাধুদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি। যেহেতু তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তাই সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী দলের চাপে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি একটি সুয়োমোটো মামলা গ্রহণ করে বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এবং ডিজিপিকে নির্দেশ দেন সাধুদের গ্রেফতার করার।
ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, তাদের এমন সব ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাতে তারা জামিনে মুক্ত হতে পারেন। তবে সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি হাতে নেওয়ার ফলে মোদি সরকার বেশ বিব্রত হয়ে পড়েছে। পাছে এই বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠে, প্রসঙ্গটি এড়াতে কেন্দ্রীয় সরকার এবার সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানায়নি বলেই কূটনৈতিক মহলের ধারণা। সাধারণতন্ত্র দিবস উদযাপনের ইতিহাসে এই প্রথমমবার এমন ঘটনা ঘটল।
নেতাজির ইচ্ছানুযায়ী ২৬ জানুয়ারি দেশের সাধারণতন্ত্র দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। প্রথা অনুযায়ী, প্রতি বছরেই দিল্লিতে সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে প্রতিটি রাজ্যের ট্যাবলো প্রদর্শন করা হয়। যেহেতু এ বছরই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী, আর ঘটনাচক্রে দিনটি ২৬ জানুয়ারির মাত্র ৩ দিন আগেই, তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার নেতাজির কর্মকাণ্ড নিয়ে এক ট্যাবলো প্রদর্শন করতে চেয়েছিল এবারের সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই ইচ্ছা কেন্দ্র মানেনি। তারা সরাসরি বাতিল করে দিয়েছে নেতাজিকে নিয়ে ট্যাবলো।
এখানেই শেষ নয়, নেতাজির কন্যা অনিতা বসু পাফ বর্তমানে কলকাতায় ছুটি কাটাচ্ছেন। তিনি মোদি সরকারকে কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, ‘আমার বাবার ১২৫ বছর পূর্ণ হবে এ বছরের ২৩ জানুয়ারি। আর এখন মোদি সরকার বাবাকে নিয়ে রাজনীতি করছে।’
অনিতা আরও বলেছেন, ‘আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, বাবার মতো একজন দেশনায়ককে বিজেপি এবং আরএসএস যেভাবে উপেক্ষা করছে, তা কল্পনার অতীত। আমি জানি না এর পেছনে কি কারণ রয়েছে এবং বাবাকে নিয়ে ট্যাবলো কেন প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হলো না। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক।’
অন্যদিকে, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে কংগ্রেস, সিপিএমও। কংগ্রেস সাংসদ তথা লোকসভায় বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা তো জানি, দিল্লির সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তলে তলে বোঝাপড়া রয়েছে। দাদার সঙ্গে দিদির তো রীতিমতো সখ্য আছে। আমাদের হারাতে দিদি এখন তো গোয়া, মেঘালয়, মনিপুর করে বেড়াচ্ছেন। তাহলে এখন নেতাজি ট্যাবলোর ব্যাপারে কেন্দ্রেকে রাজি করাতে পারছেন না কেন? এদিকে রাজ্য বিজেপির অভ্যন্তরেও ট্যাবলো বিতর্ক চলছে।
রীতিমতো মতান্তর শুরু হয়েছে। বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি দীলিপ ঘোষ কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে রাজ্যকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। বলেছেন, বেশ করেছে। ঠিক করেছে। দিল্লির লোককে বাংলায় ঢুকতে দেবে না। দিলীপ ঘোষের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্য সভাপতি, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায় মনে করেন, ২৬ জানুয়ারির কুচকাওয়াজে নেতাজি ট্যাবলো অবশ্যই থাকা উচিত। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধও করেছেন, যাতে নেতাজি তথা বাংলার অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবদান মানুষের চোখের সামনে আসে।
যা-ই হোক, কেন্দ্র সরকার শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নেতাজি ট্যাবলোকে কুচকাওয়াজের অন্তঃর্ভুক্ত করা হবে না। আর এ নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। নেতাজির মতো একজন সর্বজনপ্রিয় ও সর্বজনগ্রাহ্য দেশনেতাকে নিয়ে বিজেপি যে রাজনীতি করল, তাতে তাদের আখেরে ক্ষতিই হলো। যা আগামীদিনে আরও স্পষ্ট হবে।
লেখক: ভারতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
এসএ/