পর্যটনে বিনিয়োগ কৌশল
জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা পর্যটনের পুনরুদ্ধার এবং ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগকে অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মানুষের জন্য, পৃথিবীর জন্য এবং সমৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেছে। বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৩ উদযাপনকে সামনে রেখে এই সংস্থা বলছে যে, এখন শুধু প্রথাগত বিনিয়োগ নয় যা অর্থনৈতিক প্রচার ও তথাকথিত প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাকে এগিয়ে নেবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সরকার, বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি নতুন পর্যটন বিনিয়োগ কৌশল উদ্ভাবনের সময় এসেছে। পর্যটনের জন্য শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করে এই পৃথিবীর টেকসই অবকাঠামো এবং সবুজ রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে হবে। তাহলেই উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তার মাধ্যমে সত্যিকারের সমৃদ্ধি আসবে। সংস্থাটি টেকসই পর্যটনের জন্য টেকসই বিনিয়োগ প্রয়োজনকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ মহামারিতে আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত পতন ঘটায় এই খাতের সকল স্তরে সংকট বিরাজমান। সঙ্গে পর্যটনের জলবায়ু কর্ম প্রচেষ্টাও ব্যাহত হচ্ছে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পর্যটনের স্টার্ট-আপগুলোতে বিনিয়োগকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে এবং পর্যটন প্রযুক্তি ও ইকোসিস্টেমের স্থিতিস্থাপকতা বিবেচনা করে কর্মপ্রচেষ্টা গ্রহণ করা দরকার। তাই পর্যটনকে অধিকতর সক্ষমতা প্রদানের লক্ষ্যে খাত নির্ধারণ করে বিনিয়োগ প্রয়োজন। ফলে জনগণের জন্য নানাবিধ সুযোগ সৃষ্টি হবে, স্থিতিস্থাপক অর্থনীতি গড়ে উঠবে ও উন্নয়ন সম্ভাবনাগুলো বাস্তবতা লাভ করবে। জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মপ্রচেষ্টা এবং এই পৃথিবীর স্থায়িত্ব নিশ্চিতকল্পে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধি, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি অব্যাহত রাখতে হবে। পর্যটনে কৌশলগত বিনিয়োগ একটি প্রধান অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এই বিনিয়োগে ব্যবসা ও উন্নয়নের এর মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করবে।
পর্যটন শিক্ষা ও উচ্চতর দক্ষতা সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার বিনিয়োগ উপখাত হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। পর্যটন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী জব ফ্যাক্টরি হিসেবে পরিগণিত। ২০১৯ সালে সেক্টরটি বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জনকে নিয়োগ করেছে এবং নারী ও যুবকদের জন্য উচ্চ স্তরের সুযোগসহ নানাবিধ কর্মসৃজন করেছে। উদীয়মান গন্তব্যে ৫০ শতাংশ তরুণ-তরুণী কাজের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগের অভাবে পর্যটন শিক্ষায় যুবাদের প্রবেশ সীমিত হয়ে যাচ্ছে এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। পর্যটন আবাসনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বৈশ্বিক পর্যটনকর্মী সৃজনের লক্ষ্যে ২০৩০ পর্যন্ত লক্ষ্য স্থির করা জরুরি। কারণ এই সময়ে পৃথিবীর বহুদেশে লক্ষ লক্ষ আতিথেয়তা স্নাতকের প্রয়োজন হবে।
এই গ্রহে পর্যটনের সবুজ রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ উত্তম পরিষেবা প্রদান করতে পারে। যেমন বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন নির্গমনের ১% হয় হোটেল থেকে এবং পর্যটন খাত ক্রমবর্ধমান এনার্জি ও পানি ভোক্তাদের অন্যতম। তাই জলবায়ু প্রযুক্তি ও পর্যটনের স্টার্ট-আপগুলোর জন্য তহবিল যোগান সত্যিকারের রূপান্তরের সূচনা করতে পারে। কেবল প্রয়োজনের জন্য নয়, বরং পর্যটনের ক্রিয়াকলাপে টেকসই ব্যবস্থাকে সমন্বিত করে এই সকল বিনিয়োগ পর্যটনকে চালকের আসনে বসাতে পারে। সঠিক বিনিয়োগ ব্যয় দক্ষতা, শহর পরিচালনা নীতি, অভ্যন্তরীণ স্থায়িত্ব, ব্র্যান্ড ইমেজ ও অতিথি সন্তুষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে পর্যটন অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করবে।
পর্যটনে নানাবিধ উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমৃদ্ধি সাধনের জন্য বিনিয়োগ নীতি গ্রহণ করা উচিত। উদ্ভাবন ও ডিজিটালাইজেশনে বিনিয়োগে বহুগুণিতক সমৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধরণের বিনিয়োগ বড় আকারের বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক উন্নয়নকে শক্তিশালী করবে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে উদ্দীপিত করবে। এইক্ষেত্রে নারীদের বিনিয়োগকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। নারীদের অগ্রাধিকার বিনিয়োগ নীতি উদ্যোক্তা পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, বৈশ্বিক পর্যটনের বর্তমানে ৫৪ শতাংশ নারী পর্যটনে নিয়োজিত রয়েছেন। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ও সক্ষমতা উভয়ই বাড়ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী নারীদের দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে।
পর্যটনের বিনিয়োগ কৌশলকে নিম্নরূপে পরিশীলিত করা যায়:
ক. সরকারকে আন্তর্জাতিক ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে প্রসারিত করার মাধ্যমে মানবপুঁজি উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রবিধান এবং প্রণোদনা সৃষ্টি করতে হবে।
খ. পর্যটনের উদীয়মান বিনিয়োগের চাহিদা পূরণে বেসরকারি খাত কর্তৃক শিক্ষা উন্নয়নে গৃহিতব্য পদক্ষেপগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে।
গ. পর্যটন সবুজায়নে বর্ধিত বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বিনিয়োগকারীদের অনুপ্রাণিত করার নীতি গ্রহণ করতে হবে।
ঘ. জলবায়ু প্রযুক্তি উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে ব্যবসায়িক মডেল ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য নতুন জলবায়ু সংকট মোকাবিলার পন্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ঙ. উদ্ভাবনকে সমর্থন করার জন্য আর্থিক বিনিয়োগ ব্যবস্থা, উপকরণ ও প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে হবে।
চ. পর্যটন ব্যবসাকে সহজভাবে পরিচালনার নীতি গ্রহণ করে বিনিয়োগ নীতি আরও সহজ করতে হবে। এতে উদীয়মান ও জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্ভাবনী আর্থিক প্রক্রিয়া এবং সমাধানগুলিকে আলিঙ্গন করা সম্ভব হবে।
ছ. অর্থায়নের লিঙ্গ ব্যবধান হ্রাস করার উদ্দেশ্যে গার্হস্থ্য ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই নারীদের মূলধন বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে হবে। ফলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আন্তর্জাতিক বাজার উন্মুক্ত হবে।
উপসংহারে বলা যায় যে, পর্যটনের নানারূপ অধিক্ষেত্র যেমন পর্যটন শিক্ষা, স্টার্ট-আপ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অগ্রাধিকার বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পর্যটন বিনিয়োগ সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। বিনিয়োগে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস করার উদ্দেধ্যে নারী জনগোষ্ঠীকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে হবে। আগামী দিনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসনে এই কৌশল সমধিক উপযোগিতা সৃষ্টি করবে।
মোখলেছুর রহমান: রেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম স্টাডিজ, ঢাকা।
এসএন