টেকসই পল্লী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন
শতাব্দী প্রাচীন থেকে এ দেশের সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে পল্লী উন্নয়ন চেতনা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সঙ্গে পল্লী উন্নয়নে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন’ শীর্ষক গ্রন্থের অংশ বিশেষে তিনি উল্লেখ করেছেন–আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই, যে সমাজে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। মানুষের জীবনের নূন্যতম চাহিদা পূরণ হবে। গ্রামকেই করতে হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার মধ্যেই রয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথ। নারীর ক্ষমতায়নে সরকার বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করেছে। বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রপথিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায়, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠ অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে চলেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে–পল্লীর আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।
গত দু’দশকে টেকসই পল্লী উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিলোপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জেন্ডার সমতা অর্জন, খাদ্য নিরাপত্তা, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য নন্দিত। জাতির পিতার লালিত স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ বির্নিমানে বর্তমান সরকার দেশের সমৃদ্ধির এ অগ্রযাত্রায় পল্লী উন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। বঙ্গবন্ধুর পল্লী উন্নয়ন দর্শনের আলোকে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত আত্মনির্ভরশীল পল্লীগড়ার প্রত্যয় হউক আমাদের অঙ্গিকার। সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর পল্লী উন্নয়ন দর্শন ছিল। তার ভাষায়–আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে–এটাই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।
করোনাকালীন সময়টি পার করছে সাধারণ মানুষ জীবন ও জীবিকার সাথে লড়াই করে। নারী-পুরুষ বৈষম্যের পৃথিবীতে যখন অতিসংক্রামক এক মহামারি দরজায় হানা দিয়েছে, তখন নারীর নাজুকতা তুলনামূলকভাবে বেশি প্রকটিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বৈষম্য কমিয়ে সমতা অর্জনের পথে আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। সম্প্রতি আইএমএফ পূর্বাভাসে বলেছে, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি ৪ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিষ্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, ‘মহামারিতে লাখ লাখ জীবন ও চাকরি গেছে, প্রবৃদ্ধি আরও তলিয়ে যাবে, বাড়বে ঋণ, দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির ক্ষত হবে দগদগে। সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষতির পাল্লা নারীর দিকেই ভারী যার প্রকটতা নারীদের উপর পড়বে। চলতি বছর কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস পুরো বিশ্বে স্থবিরতা সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন প্রনোদনা কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে। বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের কাজটি শুরু করেছেন তৃণমূলের গরিব অবহেলিত নারীরাই। শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের কারণে নারীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির স্তম্ভ (পিলার) হতে পেরেছেন। পল্লী নারীরাই বেশি উৎপাদনশীল, এই অবহেলিত জনসম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তৃণমূল জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন অর্জনের যাত্রাটা খুব দীর্ঘ। এর পেছনের গল্পতে লুকিয়ে আছে প্রতিটি সরকারের নারী শিক্ষাবান্ধব কর্মসূচি।
২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ “২০৩০ এজেন্ডা” গৃহীত হয়। সারা বিশ্বের মানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে “২০৩০ এজেন্ডা” এমন একটি কর্মপরিকল্পনা যা বিশ্ব শান্তি জোরদার করবে ক্ষুধা ও দারিদ্রসহ সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটাবে। অতি দারিদ্র্যসহ সব ধরনের দারিদ্যের অবসান ঘটানোই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। আর এটাই হলো টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আগামী প্রায় দেড় দশক বিশ্বের সকল দেশ এই অভীষ্ঠগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবে যার মধ্যদিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে জনগণের সকল ধরনের দারিদ্র্যের অবসান ঘটানো সম্ভব হবে; সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান ও অসমতা হ্রাসের গুরুদায়িত্ব পালন করাসহ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি মোকাবিলার কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে। আর এসব কর্মকাণ্ডের মূলমন্ত্র হবে “কাউকে পশ্চাতে রেখে নয় No one will be left behind)নীতি অনুসরণ [টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ, লক্ষ্যমাত্রা ও সূচকসমূহ সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি), বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, এপ্রিল ২০১৭, পৃ. ৪]।
৫ নম্বর অভীষ্ঠ জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও প্রতিনিধিত্ব করছে প্রতিটি কাজে। গত দু’দশকে বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি সংগঠনে নারীর ক্ষমতায়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। টেকসই উন্নয়ন ৫নং অভীষ্ঠ লিঙ্গ সমতা অর্জন সব নারী এবং মেয়ের ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ Sustainable Development Goals–SDGs এর ৫ নম্বর অভীষ্ঠে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে আমরা বিশ্বনেতাদের অঙ্গীকার পাই এভাবে: Women–Achieve gender equality and empower all women and girls: জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন। এ অভীষ্ঠে আমরা সর্বত্র ‘সর্বক্ষেত্রে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটানো’, শোষণ-বঞ্চনা ও সকল ধরনের সহিংসতার অবসান, শ্রমের ও কাজের স্বীকৃতিদান; রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও নেতৃত্বদান এবং সকল পর্যায়ে নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন ও নারী পুরুষের সমতা আনয়ন ইত্যাদি বিষয়ে নিশ্চিত করার কথা পায়। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১ তে নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতায়নের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীরা শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত। শ্রেণি, ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, দক্ষতা প্রায় সকলক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে অসমতা লক্ষ্যনীয়। নারীদেরকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে এবং বৈষম্য অবস্থা হতে উত্তরণের লক্ষ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীর অগ্রযাত্রাকে স্থায়ী রূপ দিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা অন্তর্ভুক্ত করেন।
বেগম রোকেয়া শতবর্ষ আগেই বলে গেছেন, মানবসমাজ একটি দুই চাকার গাড়ির মতো। সমাজ এগিয়ে যায় সেই চাকার উপর ভর করেই; কিন্তু এক চাকাকে দুর্বল রেখে কিংবা অচল রেখে শুধু অপর চাকার ওপর নির্ভর করে খুব বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায়না। প্রযুক্তির বিশ্বে কথাটি বাস্তব সত্য। বেগম রোকেয়ার রচনাবলিতে আমরা দেখেছি নারী ছিল গৃহের সিলেবাসে বন্দি। সংসারের কাজ রান্নাবান্না আর স্বামী-সন্তানকে দেখভালই ছিল তার রুটিন কর্ম। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পলাতকা কাব্যগ্রন্থের ‘মুক্তি’ নামক কবিতাকে নারীদের নিয়ে সেই চিত্রই তুলে ধরেছেন। বেগম রোকেয়া নারীর ক্ষমতায়নে ভবিষ্যৎ রূপরেখা এঁকেছিলেন এভাবে: ‘তোমাদের কন্যা শিশুদিগকে শিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও দেখিবে তারা নিজেদের অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা নিজেরাই করিয়া নিতে পারিবে।...’ নারীকে বিশেষজ্ঞরা চিত্রায়িত করেছেন এভাবে: কর্মশক্তিতে সম্পদ, সংগঠিত কার্যক্রম, চেতনাগত দক্ষ ব্যবস্থাপক, দায়বদ্ধতায় সক্রিয়, নবদিগন্তের চেতনা দীপ্ত কর্মী হিসেবে। পল্লী বাংলার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগের কমতি ছিলো না। গ্রামকে তিনি নারীর সাথে তুলনা করে বলেন, ‘Villages are like women, in their keeping is the cradle of the race.’ পবিত্র কুরআন পাকে আল্লাহ বলেছেন, ‘ওয়া মা খালাকাজ যাকারা ওয়াল উমমা’। অর্থ–শপথ তাঁর যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন (সুরা আল লাইলত)। রবীন্দ্রনাথ লর্ড এলসহার্স্টের সহযোগিতায় পল্লী উন্নয়নে সফল হয়েছিলেন। তিনি পল্লী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারী সমাজকে উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখেছেন। উন্নয়ন করতে হলে এই নারী জাতিকে সঙ্গে নিয়েই করতে হবে। এই অর্থেই হেলেন ক্লার্ক বলেছিলেন, ‘জনসংখ্যার অর্ধেকের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখে কখনোই কাঙ্খিত উন্নয়ন অর্জিত হবে না।’ (Development can not be achieved if fifty percent of the population is excluded from the opportunities it brings. Helen Clark, UNDP Administrator)
‘অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশন্স’ (২০১৩) প্রবন্ধে অমর্ত্য সেন বলেছেন, “বাংলাদেশের বেগমান নারী আন্দোলন, সক্রিয় এনজিও কার্যক্রম ও বেইজিং পরবর্তী বিশ্ব নারী উন্নয়ন এজেন্ডার প্রভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি ও তা বাস্তবায়নের কার্যকর কৌশলের লক্ষ্যে যে ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে তার মাধ্যমে বাংলার নারী জীবনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা ঘটে; যাকে বিশ্ব ব্যাংক আখ্যা দিয়েছে ‘হুইসপার টু ভয়েসেস’।” জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউএনডিপি তাদের নারী উন্নয়ন অভীক্ষায় উচ্চারণ করেছে–Development, if not engendered, is endangered.
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই জেন্ডার বৈষম্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে সকল উন্নয়নের বাধা। ব্যক্তির-পরিবারের-সমাজের ও রাষ্ট্রের আর্থিক নৈতিক সাংস্কৃতিক-সামাজিক তথা সামগ্রিক অনুন্নয়ন জেন্ডার বৈষম্যের ফলশ্রুতি বলে বোদ্ধাগণ মনে করেন। মানব প্রজাতির উন্নয়ন শুধুমাত্র পুরুষের উন্নয়নের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। নারী পুরুষের মিলিত অবস্থান ও উন্নয়নই প্রগতির পথকে সচল রাখতে পারে–মানবজাতিকে আলোকিত ভোরের সন্ধান দিতে পারে। আমাদের অবশ্যই ভুললে চলবে না–The Human Species is a Two-winged bird: One wing is female–The other is male. Unless both wings are equally developed–the human species will not be able to fly. (নারীর ক্ষমতায়নে সমবায়: অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা, বাংলাদেশ সমবায় একাডেমি, কুমিল্লা, জুন ২০২০, পৃ. ৩১)। সুতরাং নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন ও বৈষম্য নিরসন সম্ভব নয়।
সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এক সমদ্ধির ধারা–দিনবদলের সনদ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করে তৃতীয় মেয়াদে ২০১৮ সালে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার প্রত্যন্ত পল্লী এলাকায় নাগরিক স্বাচছন্দ্য ও স্বাচ্ছল্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ যে ধারণা ব্যক্ত করেছে তা প্রশংসনীয়। বিশ্বব্যাপী গৃহীত ও অনুসৃত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ ২০৩০ সামনে রেখে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে ‘সোনার বাংলায়’ রুপায়ন এবং ২১০০ সালে নিরাপদ ব-দ্বীপের অন্বেষায় সামগ্রিক ও টেকসই পল্লী উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ (এসডিজি)’ অর্জনে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদ্যমান প্রকল্প ও কর্মসূচি সমূহের কার্যক্রম পুনর্বিন্যাস ও নতুন প্রকল্প গ্রহণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের সকল আধুনিক সুযোগ সুবিধা প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো এবং তা হতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে পরিকল্পনামাফিক পরিবেশসম্মত পল্লী জনপদ তৈরি করা। ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালীকরণে সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন জোরদারকরণ ও পল্লীর নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত কর্মকাণ্ডে দক্ষতা ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমে কিভাবে তাদের ক্ষমতায়ন করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
দেশের সামগ্রিক ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে পল্লীউন্নয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বব্যাপী গৃহীত ও অনুসৃত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ ২০৩০ এ সর্বত্র সকল ধরনের দারিদ্র্যর অবসান,খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির প্রসার, জেন্ডার সমতা অর্জনসহ গুরুত্বপূর্ণ অভীষ্ঠ নিধারণ করা হয়েছে। এ সকল অভীষ্ঠ টেকসই পল্লী উন্নয়নের সাথে সরাসরি সর্ম্পকিত।দেশের মোট জনসংখ্যার ৬২% মানুষ এই পল্লীতে বাস করে। এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ব্যাতীত দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।বাংলাদেশ এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরন ঘটেছে। পল্লীর মানুষকে অশিক্ষিত ও নিরক্ষর রেখে টেকসই পল্লী উন্নয়ন অর্জন সম্ভব হবেনা। একটি জনগোষ্ঠির জীবিকার উন্নয়ন হতে হবে সমতা ও সাম্যের ভিক্তিতে তাহলে উন্নয়ন হবে টেকসই। একটা প্রবাদ আছে–God made the country, men made the towns. একটি উন্নত পল্লী তখনই আশা করা যাবে যখন সেখানকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, চলমান জীবনধারা, কৃষ্টি সংরক্ষণ করে আধুনিকতার পরিশীলিত ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত পল্লীর রুপরেখা প্রনয়ন করা হবে। বর্তমান প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পল্লীর আনাচে কানাচে উন্নয়নের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রতিনিয়ত আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
বাংলাদেশের একজন পল্লী উন্নয়ন গবেষক হিসেবে লক্ষ্য করেছি পল্লী এলাকায় আ্যাকশন রিসার্চ ও প্রায়োগিক গবেষণার চরম অভাব। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কুমিল্লা মডেলের স্বপ্নদ্রষ্টা ড. আকতার হামিদ খান পল্লী উন্নয়নে গবেষণার যে স্বপ্ন বীজ বপন করে রেখে গেছেন পল্লীর অন্দর মহলে তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পায়। নারীরা আজ স্বাবলম্বী হয়েছে, পরিবারের আয় ও বেড়েছে, যা পল্লী এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সরকারি সেবা বিভাগের পাশাপাশি অনেক এনজিও তাদের কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ যথেষ্ঠ দক্ষতার সাথে এই মহামারি জীবনরক্ষা ও জীবিকা নিশ্চিতকরণ উভয় দিক থেকে মোকাবেলা করছে। পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে অর্থনীতির সচল চাকায় যুক্ত করার প্রয়াসে অধিকতর জোর দিতে হবে। অন্যথায় অথনৈতিক বৈষম্য বেড়ে গেলে টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে মারাত্বকভাবে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পল্লী এলাকা উন্নত ও সমৃদ্ধ হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নেয়া সম্ভব হবে। ১৯৭২ সালে যে দেশের আয় ছিল মাত্র ৮০০ কোটি টাকা, তার অথনৈতিক সক্ষমতা এখন ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রা দেখে জাতিসংঘের এসডিজি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বিষয়ক উপদেষ্টা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক জেফরি স্যাকস বাংলাদেশকে “জুয়েল ইন আ ক্রাউন” বলে অভিহিত করেছেন।
উন্নয়ন ও অগ্রগতির আর ও একটি বছর জাতিসংঘের SDG অগ্রগতি পুরস্কার। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে ভূষিত করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন–যখন আমরা উন্নয়নের কথা বলি তখন আমরা জাতি, ধর্ম,বর্ণ,গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথাই বলি। একশন এইড বাংলাদেশের কান্টি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, এসডিজির মূল বিষয় হলো কেউ পিছিয়ে থাকবেনা।
উন্নয়নের প্রতিটি পর্যায়ে যুবদের অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুব নারীরা যাতে চোখের আড়ালে থেকে না যান, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ (এসডিজি) অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রস্তাব করেছে। এসডিজির গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কারণ প্রযুক্তি স্বচ্ছতার ক্ষেত্র ও প্রসারিত করে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষনা প্রতিষ্ঠান এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর আগে বাংলাদেশ যে গতিতে এগোচ্ছিল, তাতে এসডিজি অনুযায়ী ২০৩০ সালে দারিদ্যমুক্ত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অনায়াসে অর্জন করে ফেলত। কিন্তু এখন সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য দরকার আর্থিক সহায়তা। একটি উন্নয়ন তখনই টেকসই হবে যখন সেবাগ্রহণকারীরা উন্নয়নকে দরদ দিয়ে নিজেদের আর্থসামাজিক অস্তিত্বের একটি বৃহৎ অংশ বলে মনে করবে।
বর্তমানে অনেক চ্যালেঞ্জিং পেশা নারীরা গ্রহণ করছেন। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীর টিকে থাকার জন্য যে সামাজিক, পারিবারিক ও পরিবেশগত সুরক্ষা প্রয়োজন তা তাঁরা পাননা। ফলে একটা সময় তারা উচ্চশিক্ষা নিয়েও গৃহবন্দি থাকতে বাধ্য হন। লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পথ এগিয়েছি। কিন্ত এখানেই থেমে থাকলেই চলবেনা। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে তাদের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের আয় রোজগার কমে গিয়ে দারিদ্য বেড়েছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য সরকারের বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো আরও বিস্তৃত করতে হবে। বাংলাদেশে লিঙ্গ সমতা না আসার পেছনে আমাদের আর্থসামাজিক কারণ যেমন আছে, তেমনি আছে মনস্তাত্বিক। সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোর পক্ষে কথা বলার যেমন লোক আছে, তেমনি অভাব নেই বিদ্যমান অবস্থা টিকিয়ে রাখার পক্ষের মানুষেরও। এখনও অনেকে মনে করেন, পরিবারের আর্থিক সংগতি থাকলে নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরী করার প্রয়োজন নেই। নারীদের হাতে অর্থ এসেছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে নারীরা, সমাজে নারীদের ক্ষমতায়ন ঘটেছে, অবদান বেড়েছে। জনসংখ্যার অর্ধেক অংশকে উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবেনা। শ্রমশক্তি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অন্যতম সম্পদ।এই শ্রমশক্তির উপর ভর করে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে দ্রত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নীত হয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে স্থান করে নেবে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করেছে।নারী শিক্ষা,নারী অধিকার,নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নারী জাগরণ, পল্লীউন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ নারীদেরকে সম্মানিত করার জন্য সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই। বিষয়টি নারী ক্ষমতায়নের একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের মাস্তুলে চড়ে নারীরা এগিয়ে যাবে, দেশ ও এগোবে সরকারের প্রতিটি সেক্টরে নারী বান্ধব পরিবেশ বজায় থাকবে সেটাই প্রত্যাশা। পল্লীউন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ আমি বেগম রোকেয়া পদক ২০২১ প্রাপ্ত হয়েছি। এটা আমার জন্য আশির্বাদ ও আলোকবর্তিকা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি রইলো আমার কৃতজ্ঞতা, তিনি পল্লী উন্নয়ন গবেষণায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং একজন নারী গবেষককে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। আগামিতে পল্লীর মানুষের জন্য কাজ করার স্পৃহা তৈরিতে এ সম্মাননা আমার জীবনে আলোর দিশারী হয়ে থাকবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে পদার্পন করেছে এবং বিস্ময়কর সফলতা লাভ করে চলেছে সেই সাথে তাল মিলিয়ে এদেশের নারীরা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শামিল হবে গর্বিত সহযোগী হয়ে এটাই ভবিষৎ প্রত্যাশা।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ; লেখক ও গবেষক
এসএ/