নাসিকে উত্তাপ, গডফাদার এবং সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গ
ছোটবেলায় বড়দের মুখে শোনা একটি গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। গ্রামের এক মাতব্বর গোছের লোক তার প্রতিবেশীদের ডেকে বললেন, ও মিয়া, তোমরা আমার কাছে এটা চাও, সেটা চাও। আমার কি রাজার গোলা আছে? আমি কোত্থেকে দেব? আমাকে মেম্বার বানাও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য অনেক কিছু করতে পারি!
গ্রামের লোকরা দেখল, মাতব্বরের কথা ঠিক। তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, মাতব্বরকে মেম্বার বানাতে হবে। গ্রামের লোকজন বলল, ঠিক আছে। আমরা ভোট দেব। আপনি ভোটে দাঁড়ান।
মাতব্বর ভোটে দাঁড়াল। লোকজন ভোট দিয়ে তাকে মেম্বার বানাল। তারপর মাতব্বরের কাছে লোকজন গিয়ে বলল, মাতব্বর সাব, মেম্বার তো বানাইলাম। এবার আামাদের জন্য কিছু করেন।
নয়া মেম্বার বললেন, মেম্বার বানাইছ ঠিক আছে; কিন্তু মেম্বারের কোনো ক্ষমতা আছে? সব ক্ষমতা চেয়ারম্যানের। আমারে চেয়ারম্যান বানাও। তারপর তোমাদের জন্য যা যা করা দরকার, তা করব।
জনগণ কী আর করবে! পরের বার মাতব্বরকে চেয়ারম্যান বানাল। তারপর আবার মাতব্বরের কাছে লোকজন গিয়ে বলল, এবার তো আপনার অনেক ক্ষমতা। এবার আমাদের জন্য কিছু করেন।
নয়া চেয়ারম্যান বললেন, কি যে বলো তোমরা! চেয়ারম্যানের কোনো ক্ষমতা আছে? সব ক্ষমতা উপজেলা চেয়ারম্যানের। আমারে উপজেলা চেয়ারম্যান বানাও। তারপর যদি কিছু করতে পারি!
বোকা জনগণ পরের বার ভোট দিয়ে মাতব্বরকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানাল। তারপর তার কাছে গিয়ে বলল, মাতব্বর সাব, এবার তো আপনার বেশুমার ক্ষমতা। এবার আমাদের জন্য কিছু করেন!
নয়া উপজেলা চেয়ারম্যান বললেন, আর বইলো না! আগে শুনছিলাম সব ক্ষমতা নাকি উপজেলা চেয়ারম্যানের; কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পর দেখি, এরা হলো ঠুটো জগন্নাথ! ঠুটো জগন্নাথ বোঝ তো! নাম আছে কাম নাই! সব কাজ এমপি সাব করে। আমি হলাম ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। এমপি সাবের পেছনে পেছনে ডুগডুগি বাজাই। এবার বুঝছ তো!
জনগণ বলল, তাইলে এখন কি করা? আমরা তো আশায় আশায় কত বছর পার করলাম! কখনোই কিছু পাইলাম না।
মাতব্বর সাব মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, দেখ যদি আগামী নির্বাচনে এমপি বানাতে পার; তাহলে হয়তো তোমাদের জন্য কিছু করতে পারি।
জনগণ আর কী করবে? তারা অসহায়! ভোট এলে তাদের কদর বাড়ে। বাকি সময় কেউ তাদের খোঁজ রাখে না। সবাই কেবল আশা দিয়ে রাখে। আশায় আশায় তাদের দিন কাটে। তবু তারা আশা হারায় না। তারা এবার মাতব্বরকে ভোট দিয়ে এমপি বানাল। ভোটে জিতে মাতব্বর এলাকাছাড়া হলেন। জনগণ তার টিকিটিও ছুঁতে পারল না!
এই হলো বর্তমান জমানার ভোটের চিত্র। জনগণ কেবল ভোট দেওয়ার মালিক আর ক্ষমতার মালিক এমপি সাব!
গত কিছুদিন ধরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা চলবে। নির্বাচনী প্রচার বেশ জমে উঠেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জের অলিগলি চষে বেড়াচ্ছেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন তারা। গণতন্ত্রে এ এক অপার সৌন্দর্য।
প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। নির্বাচন এলেই সেই কথা নেতাদের মনে পড়ে। ভোটের জন্য ভোটারের কাছে ছুটতে হয় তাদের। কাউকে চাচা, কাউকে মামা, কাউকে ভাই, কাউকে খালাম্মা আবার কাউকে বোন বলে সম্মোধন করেন। ভোট ভিক্ষা চান। কেউ বলেন, আইভী আপা যেখানে ভোট দেব সেখানে। আবার কেউ বলেন, তৈমূর ভাই যেখানে ভোট দেব সেখানে। মাঠে অন্য প্রার্থীরাও আছেন; কিন্তু তাদের নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছেন না। সবার দৃষ্টি আইভী-তৈমূরের দিকে।
নির্বাচনে নেমে তৈমূর খন্দকার বিএনপির দলীয় পদ হারিয়েছেন। তা নিয়ে তার কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ নেই। অনেকেই বলছেন, এটা লোকদেখানো বহিষ্কার। কাগজে-কলমে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও বিএনপির সমর্থন তার উপরই থাকবে। তা ছাড়া বিএনপির ভোটারও তাকেই ভোট দেবে। বিএনপির ভোটাররা নিশ্চয়ই আইভীকে ভোট দেবে না। আবার আওয়ামী লীগের সব ভোট আইভীর বাক্সে পড়বে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ সেখানকার এমপি শামীম ওসমান এবং তার অনুসারীরা আইভীর পক্ষে নেই। কোনো নির্বাচনী প্রচারেও তাদের দেখা যাচ্ছে না। শামীম ওসমান কার পক্ষে থাকবেন, তা নিয়ে যখন আলোচনা সমালোচনা তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়ে আইভী বোমা ফাটালেন। তিনি বললেন, তৈমূর খন্দকার গদফাদার শামীম ওসমানের প্রার্থী।
সঙ্গত কারণেই শামীম ওসমান তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। পারিবারিকভাবেই আইভীর সঙ্গে শামীম ওসমানের বৈরি সম্পর্ক। সেই বৈরিতার নেতিবাচক প্রভাব ভোটের মাঠে পড়ে থাকে। আগেও পড়েছে, এবার পড়ছে। এবার প্রকাশ্যে শামীম ওসমানের রুদ্রমূর্তি কেউ দেখতে পায়নি। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে নৌকার পক্ষে থাকার অঙ্গীকার করেছেন; কিন্তু তার কথায় বিশ্বাস নেই আইভীর। তিনি মনে করেন, শামীম ওসমান এবং তার অনুসারীরা আইভীর বিপক্ষে কাজ করছেন এবং শেষপর্যন্ত এটা অব্যাহত রাখবেন। এতে হয়তো তৈমূর খন্দকার লাভবান হবেন। তিনি নিজেও মনে করেন, বিএনপি এবং সমমনা ভোটাররা কখনোই আইভীর পক্ষে যাবেন না। তারা তাকে ভোট দেবেন।
আমরা দেখছি, যতই দিন যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ভোটের মাঠে ততই উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কথার উত্তাপই শুধু নয়, মিছিল মিটিংয়ের উত্তাপও ছড়াচ্ছে নগরীর আনাচে কানাচে। এই উত্তাপ যেন সংঘাত সংঘর্ষের পর্যায়ে না যায় প্রার্থীদের সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকেও সতর্ক থাকতে হবে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের এটাই শেষ নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নানাভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেনি বর্তমান ইসি। শেষবারের নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে না পারে তাহলে তাদের বিদায়টাও বিষাদের হবে। নিশ্চয় তারা বিষাদময় বিদায় টেনে আনবেন না। আমরা একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখার জন্য অধীর আগ্রহ অপেক্ষা করছি।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ ও সাহিত্যিক
এসএ/