জলের তলে মন্ত্রিসভা
১৭ অক্টোবর ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ। ছোট্ট একটি ঘটনা বিশ্ব বিবেকের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল। যদিও ঘটনাটি অনেকেই হাসির ছলে নিয়েছেন। তথাপিও সেই ঘটনাটি বিশ্ব ইতিহাসের অলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে ধরা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটিয়েছেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। তিনি জলবায়ু মোকাবিলার লক্ষ্যে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এক অভিনব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তার মন্ত্রিসভার ডজন খানেক সদস্য নিয়ে সমুদ্রের ২০ ফুট নিচে জলবায়ু ও পরিবেশ দূষণসংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকে মালদ্বীপের একমাত্র নারী সদস্যও উপস্থিত ছিলেন।
এই সময় প্রত্যেকেই স্কু বা ডাইভিং পোশাকে আবৃত ছিলেন। এর জন্য অবশ্য তারা পূর্বে বিশেষ প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন, অবশ্য প্রেসিডেন্ট নিজে প্রশিক্ষিত ডুবুরি ছিলেন, বিধায় তার জন্য কাজটা কিছুটা সহজ হয়েছে। তথাপিও প্রত্যেকের পাশেই একজন করে প্রশিক্ষিত ডুবুরি ছিলেন। কোনো সমস্যা হলে যেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ সময় তারা ইশারায় তথ্য আদান-প্রদান করেছেন।
টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে, সমুদ্রের জলের নিচে প্রবাল রাজ্যে চেয়ার টেবিলে বসে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে, বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে, জনমত গড়ার লক্ষ্যে এক প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন তিনি। যাতে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন-এ জলবায়ু সম্মেলনে বিষয়টি প্রাধান্য পায়। প্রায় আধ ঘণ্টার মতো ‘জলের তলে মন্ত্রিসভা’র বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট উপরে এসে গণমাধ্যমকে জানালেন, ‘বৈঠকে কথা কম হলেও কাজ হয়েছে বেশি।’
মূলত তিনি এক প্রতীকী আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে বার্তা দিয়েছেন যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ মালদ্বীপসহ এশীয় অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তখন দ্বীপবাসী তথা ভুক্তভোগী মানুষজনকে টিকে থাকতে হলে সমুদ্রের জলের তলের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই হতে হবে। অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে নিয়ে সমুদ্রের হিংস্রপ্রাণীদের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার নিম্ন অঞ্চলের মানবজাতিকে বসবাস করতে হবে।
এই বিষয়টি প্রথমে ভালোভাবে নেয়নি অনেকেই; ঠাট্টা বিদ্রুপও করেছেন, পাগলামি বলেও মন্তব্য করেছিলেন কেউ কেউ। দিন, মাস বছর অতিবাহিত হতেই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা, ভাবছেন সাধারণ মানুষও। বিশ্ববাসী এখন অনুধাবন করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যেমন বেড়েছে, তেমনি পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে অতিদ্রুত। অবিরত হিমালয় ও অ্যান্টার্টিকার বরফের চাঁই গলে নিম্ন এলাকাগুলো ধীরে ধীরে প্লাবিত হচ্ছে; সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ বন্যারও। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে ওজোনস্তর পাতলা হয়ে পৃথিবীকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলে প্রবল বেগে ঢুকে পড়ছে সূর্যের অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় রশ্মি। এতে করে বছরান্তেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সঙ্গে নয়া রোগব্যাধিরও আবির্ভাব ঘটছে পৃথিবীতে। আবার নয়া পরিবেশে টিকে থাকার মতো কীট-পতঙ্গও জন্ম নিচ্ছে।
অপরদিকে ওই পরিবেশে বা তাপমাত্রায় টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাওয়া প্রাণিকুলকে বিদায় নিতে হচ্ছে পৃথিবী থেকে। যাকে বলা হয় বিবর্তন বা প্রকৃতির ধারাবাহিক পরিবর্তন। যার জন্য অনেকেই প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে দোষারোপও করে যাচ্ছেন। আসলে কিন্তু বিষয়টা তা নয়, এর জন্য মোটেও দায়ী নয় প্রকৃতি; দায়ী হচ্ছে মানবজাতি দ্বারা অতিমাত্রার কার্বন নিঃসরণ এবং পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করণ। বিশেষ করে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো।
বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, নদী শাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর খামখেয়ালিপনার কারণে সিএফসি গ্যাস, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে গেছে। যে গ্যাস নিঃসরণের কারণে পৃথিবীর ফিল্টার নামে খ্যাত ওজোনস্তর পাতলা হয়ে ভূপৃষ্ট তপ্ত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। অর্থাৎ সূর্যের প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে ছেঁকে বিশুদ্ধ করে পৃথিবীর উপযোগী তাপমাত্রা পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে ওজোনস্তর।
উল্লেখ্য, পৃথিবীর জন্য সুষম তাপমাত্রা হচ্ছে ১০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (কমবেশি হতে পারে)। অথচ সেই সুষম তাপমাত্রা এখন আর বিরাজ করছে না, বরং উল্টোটি ঘটছে। ধীরে ধীরে বরফ যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। ৮ জুন, ২০১৯ সালে কুয়েতের তাপমাত্রা বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল পর্যন্ত। কুয়েতেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছিল। ওই তাপে গাড়ির চাকার টায়ারও গলে গেছে। অবাককরা বিষয় হচ্ছে, ছায়াযুক্ত স্থানেও ছিল ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। যেই তাপমাত্রায় একজন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিনতর হয়ে পড়ে।
উদাহরণ হচ্ছে, তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে গেলেই ডিম সিদ্ধ হতে থাকে, সেক্ষেত্রে ৬৩-৭০ ডিগ্রি অতি নিকটেই। কাজেই আমরা বলতে পারি, এটি বিশ্বের জন্য অতি ভয়ানক একটি অশনি সংকেত। উন্নতদেশে এই তাপমাত্রায় মানিয়ে নেওয়ার সুব্যবস্থা থাকলেও দরিদ্র দেশের ক্ষেত্রে কেবলই প্রকৃতির উপরে নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। উল্লেখ্য, এর আগে ১৯২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, লিবিয়ার আল-আজিজিয়ায় ৫৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও শৈত্যপ্রবাহের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধরনের দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। সেটি হতে পারে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্প ও নদীভাঙন। তার মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে পৃথিবীকে। যদিও প্রকৃতির প্রতিটি দুর্যোগই ভয়াবহ, তথাপিও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে অন্যসব দুর্যোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবার এল-নিনো অথবা লা-নিনার বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। এল-নিনো ও লা-নিনা হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সমুদ্রপৃষ্ঠের অত্যাধিক উষ্ণপ্রবাহ, যা সাধারণত একটানা তিন মৌসুম জুড়ে থাকে। যার আগমন ঘটে প্রতি ২-৭ বছর পরপর। এল-নিনোর সঙ্গে একটি বিশেষ ক্রিয়ার যোগ ঘটে বায়ুমণ্ডলীয় ক্রিয়ার ফলে। যাতে ইন্দোনেশিয়া ও পেরু অঞ্চলের কাছে একটি করে দুটি চাপবলয় সৃষ্টি হয়। সেই দুই চাপবলয়ের মধ্যে তীব্রগতিতে তাপ প্রবাহের আদান-প্রদান চলতে থাকে। তাতে ইন্দোনেশিয়া-পেরু পর্যন্ত সমুদ্রভাগে দক্ষিণমুখী উষ্ণতম স্রোতের সৃষ্টি হয়। যার ফলে এই অঞ্চলের বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্র উষ্ণতর হয়ে অনাবৃষ্টির সৃষ্টি হয়। যে কারণে মাছ কিংবা ক্ষুদ্র প্রাণিকুলের মৃত্যু ঘটে অস্বাভাবিকভাবে। বিশেষ করে সমুদ্রের এককোষী জীব প্লাঙ্কটনের মৃত্যু ঘটে বেশি। পরিণামে সমুদ্রের পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়তে থাকায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সেক্ষেত্রে সামুদ্রিক প্রাণিকুল অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।
আর লা-নিনার প্রভাব হচ্ছে এল-নিনোর সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ তাপমাত্রা কমে শীতল হয়ে পড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ। তাতে অতিবৃষ্টির সৃষ্টি হয়ে বন্যায় প্লাবিত হয় উপকূলীয় অঞ্চল, দেখা দেয় তীব্র নদীভাঙন।
উপরোক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বলতে হয়, আসুন আমরা সতর্ক হই এখনই। যদিও আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই, তথাপিও চেষ্টা করি বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জিততে। আসুন, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করে প্রচুর বনায়ন সৃষ্টি করি। খনিজ ও জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করি। নিজের অবস্থানে থেকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করি।
কাজটি আমাদের পক্ষে করা সম্ভবও; খুব জটিল কিছু নয়। যে যেখানে যেভাবেই আছি, ইচ্ছে করলে সেই জায়গায় থেকেই সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াসে কাজ করতে পারি। তবে ইচ্ছে শক্তির ঘাটতি হলে তা সম্ভব হবে না। বন্যপ্রাণী নিধন, বৃক্ষ নিধনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই সার্কেলটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্ক। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের বিষয়টিও। সুতরাং আমরা সচেষ্ট হই, পরিবেশ আন্দোলনে যোগ দিয়ে পরিবেশ বাঁচাই, দেশ বাঁচাই, বিশ্ব বাঁচাই; সর্বোপরি নিজেরাও বাঁচি। ভবিষ্যত প্রজন্মকে জলের তলে যেন বসবাস করতে না হয় সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেই এখনই।
আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
এসএন