ঋণখেলাপি এবং আইএমএফের ঋণ
দেশের অভ্যন্তরে ঋণ দেওয়া আর বাইরে থেকে ঋণ নেওয়া এই দুই সংকট মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। টাকা তো খরচ করার জন্যই। টাকা নাকি চাকার মতো। যত ঘোরে তত পথ অতিক্রম করে। কিন্তু যদি আটকে যায় কোথাও তাহলে সংকট তৈরি হয়। তখন কাগজের হিসেবে থাকে কিন্তু বাস্তবে পকেটে থাকে না। ঋণখেলাপিদের কাছে টাকা থাকলেও তেমনি হয়। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুয়ায়ী খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ যাবত কালের এটাই সর্বোচ্চ হারে খেলাপি ঋণ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলামের মতে খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেছেন খেলাপি ঋণকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, খেলাপি ঋণের যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে বলতে গেলে এটা কিছুই নয়। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হবে। কারণ, একদিকে ঋণ আদায় হচ্ছে না অন্যদিকে ঋণ বিতরণ চলছে।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, যারা ঋণ পরিশোধ করছেন না তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে। এর সঙ্গে কোনো ব্যাংকার, পরিচালক জড়িত আছেন কি না তা দেখে তাদের বিরুদ্ধে আগে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এই তিন অর্থনীতিবিদের কথায় সংকটের চিত্র এবং করণীয় ফুটে উঠেছে। এখন দেখতে হবে সরকার কী করে? কারণ, আলোচনা যতই হোক না কেন পদক্ষেপ তো নিতে হবে সরকারকেই। এরই মধ্যে খবর হলো, গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
আমদানি রপ্তানির পার্থক্য বেড়েই চলছে ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রতি মাসে ১.৩ বিলিয়ন ডলার করে। চলতি বছরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমেছে ১১ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের গতি কমেছে। আর বৈদেশিক মুদ্রা খরচের প্রধান খাত আমদানি ব্যয় বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম বলে লেনদেনের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে ডলার সংকট নিয়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রেখে সমস্যা নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেলে অল্প অল্প করে টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করতে বাধ্য হয়। এরপর ডলারের দর আর তেমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাজারে ডলারের দর ১১২ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা শুরু করে। এতে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ৩ হাজার ৪৩৩ কোটি ডলারে, যদিও আইএমএফ প্রতিনিধি দলের মতে, হিসাবটি পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, নানা কারণে ৭২০ কোটি ডলার ব্যবহার করা হয়েছে, সেই হিসাবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৭০০ ডলারের কিছু বেশি।
বৈদেশিক মুদ্রার উৎস রপ্তানি, প্রবাসী আয় এবং বিদেশী বিনিয়োগ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সুত্রে জানা যায়, অক্টোবরে রপ্তানি আয় গত বছর একই মাসের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর মাসে কমেছিল সোয়া ৬ শতাংশ। অথচ এর আগে টানা ১৩ মাস রপ্তানি আয় বেড়েছিল। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। রপ্তানিকারকদের আশঙ্কা, সামনে এই আয় আরও কমবে। আবার গত অক্টোবরে আসা প্রবাসী আয় গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সব মিলিয়ে গত চার মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি সামান্য, মাত্র ২ শতাংশ। আশার কথা এই যে, চলতি অর্থবছরে ৯ লাখের বেশি শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন। তারা আয় পাঠানো শুরু করলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে এ জন্য বাজারদর মেনে বিনিময় হার ঠিক করাটা জরুরি। নইলে হুন্ডি আরও বাড়বে। অর্থ পাচার ঠেকানোর কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ সরকারের নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবার ডলারের উচ্চ দর সামলাতে গলদঘর্ম হচ্ছে সরকার। বিদেশি বিনিয়োগ স্বাগত জানাতে সব ধরনের প্রস্তাব দিতে চাইছে।
বিশ্ব অর্থনীতির সংকট সহসাই কি নিরসন হবে? উত্তর হচ্ছে, না। আর বাংলাদেশের সংকট তো বহুমাত্রিক। কারণ, জ্বালানি তেল, কয়লা ও এলএনজি আমদানির উপর নির্ভরশীল দেশে আমদানির জন্য ডলার পাবে কোথায়? এরকম অবস্থায় ঋণ নিয়ে আলোচনার জন্য আইএমএফ প্রতিনিধিদল এসেছিল। তারা ফিরে গিয়ে কী প্রতিবেদন দেবে তার উপরই নির্ভর করছে ঋণের ভবিষ্যৎ। আইএমএফ ঋণ দিলে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা এগিয়ে আসবে এই ভরসা করছে সরকার।
ঋণ শোধ দেওয়ার ক্ষমতা আছে বলে সাত মাসে ৪২ কিস্তিতে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব আছে আইএমএফ এর। এর পরিমাণ প্রতি কিস্তিতে ৬৪ কোটি ডলার অর্থাৎ মাসে ১১ কোটি ডলারের কম। অন্যদিকে, গড়ে প্রতি মাসে বাংলাদেশের আমদানি খরচ ৭৫০ কোটি ডলার। তারপরও আইএমএফ এর শর্তে সরকার যদি আমদানি শুল্ক কমায় তাহলে দেশীয় শিল্প হুমকির মধ্যে পড়বে।
জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম যদি বাড়ায় তাহলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, বেশি সুদের হারে (২ দশমিক ২০ শতাংশ) ঋণ নিলে পরিশোধের দায় বাড়বে। পাশাপাশি স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণের আশ্বাস পেয়েছিল ৩৭ বিলিয়ন ডলার আর ঋণ ছাড় হয়েছে ২৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। সুদাসল মিলে বাংলাদেশ শোধ করেছে ৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি, ডলার পাচার বন্ধ না করে, ঋণখেলাপিদের টাকা উদ্ধার না করে এবং কৃষিতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে যদি অনৈতিক ও অসম শর্তে ঋণ নেওয়া হয় তাহলে বর্তমান সংকট সামাল দেওয়া গেলেও ভবিষ্যতের ঋণের ফাঁদ আরও কঠিনভাবে চেপে বসবে।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)