পল্লি উন্নয়নে স্বপ্ন যার আকাশচুম্বী
১৯১৪ সালের ১৪ জুলাই ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরিলিতে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিল এক শিশু। বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে তার মস্তিষ্কে আবর্তিত হলো মা, মাটি ও পল্লির ভাবনা। পল্লির ভাবনায় তাকে ইতিহাসের এক অনন্য মর্যাদার মুকুট পরিয়ে দিল- তিনি হলেন ড. আখতার হামিদ খান।
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের এক পুলিশ কর্মকর্তার সন্তান হয়েও ভাবনায় এঁকেছিলেন পল্লিকে নিয়ে সবুজ স্বপ্ন। একজন ধার্মিক মায়ের অনন্য সন্তান হিসেবে মা তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন উচ্চমানের চিন্তা-চেতনা ও সাধারণ জীবনযাপনের। সমন্বয়বাদী চিন্তাধারার ধারক হিসেবে নিজে অবিচল থেকে খেটে খাওয়া দিনমজুর ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট মানুষের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করেছিলেন; যে কারণেই তিনি হতে পেরেছিলেন বিশ্ববরেণ্য সমাজবিজ্ঞানী, বাংলাদেশের পল্লি উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও পথিকৃৎ। দর্শনের প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ। সেই থেকে তিনি জার্মান দার্শনিক নীটশের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে পড়েন। আইসিএস অফিসার হয়েও ড. আখতার হামিদ খান নিজেকে আবিষ্কার করলেন পল্লিবাসীর পল্লির মায়া জাগানো আনন্দ-দুঃখ-কষ্টের এক ভিন্ন কোলাহলে।
বাংলাদেশ পল্লিউন্নয়ন একাডেমি, কোটবাড়ী, কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত আখতার হোসেন খানের লেখা ‘আখতার হামিদ খান একটি স্মৃতিচারণ’ গ্রন্থের ১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন “একটি অতি চিন্তাশীল মেজাজ নিয়ে আমি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি এবং আমার জীবনের একটি আধ্যাত্মিক গোপনীয়তা আছে। দেখা যায়, নাটকের অনুপ্রেরণায় তিনি যে সুপারম্যান হয়েছিলেন বা ইকবালের অনুপ্রেরণায় যে পর্বত চূড়াবাসী জাকাল বাজপাখি হয়েছিলেন তা তাকে ধরে রাখতে পারেনি। দূরে থেকেও তিনি হলেন সুদূরের পিয়াসী।”
এভাবেই পল্লি উন্নয়নের পথিকৃৎ আখতার হামিদ খানের নেতৃত্বে চলল গবেষণা। প্রথমে সরকারি অফিসাররা গ্রামের মানুষের জন্য কী কী কাজ করতে পারছেন না সেগুলো পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি ও তার সহকর্মীরা। এ স্তরের গবেষণা হলো অবজারভেশনাল রিসার্চ। দ্বিতীয় স্তরে চলল সার্ভে রিসার্চ। তৃতীয় স্তরের গবেষণার নাম দেন অ্যাকশন রিসার্চ। চতুর্থ পর্যায়ে তিনি আসেন পরীক্ষামূলক প্রজেক্টে। এই প্রকারের গবেষণার নাম দেন তিনি পাইলট প্রজেক্ট। পল্লি উন্নয়নে আখতার হামিদ খানের সৃজনশীল গবেষণা আজ সর্বত্র অনুসৃত।
ড. আখতার হামিদ খানের অক্লান্ত চেষ্টায় সফল হয়েছিল পল্লি উন্নয়নে কুমিল্লা পদ্ধতি। তিনি এক আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গ্রামে গ্রামে ঘুরলেন এবং দারিদ্র্যপীড়িত মানুষকে কর্মক্ষম করে তোলার মানসে গড়ে তুললেন কো-অপারেটিভের প্রাথমিক স্তর। থানা পর্যায়ে গড়লেন দ্বিতীয় স্তরের কো-অপারেটিভ থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি। ফলে দরিদ্র কৃষকেরা সঞ্চয় শেয়ার ক্রয় ও সর্বোপরি পেল ঋণ সুবিধা। ঋণের টাকায় কৃষিযন্ত্র কিনে যান্ত্রিক চাষাবাদ, উন্নত সার ও বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি শুরু করলেন।
থানা সমিতি থেকে ঋণ দিয়ে কৃষকেরা রাইচমিলের মতো কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুললেন। ড. আখতার হামিদ খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কুমিল্লায় যে সার্বিক গ্রাম উন্নয়নের ধারণা তিনি পেয়েছিলেন, তা তিনি ডেনমার্ক ও তাইওয়ান থেকে মনে প্রাণে গেঁথেছিলেন।’ নারী মুক্তি সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, ‘ইতিহাস নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেয়নি। কিন্তু ইতিহাসের কোনো পর্যায়ে নারী ছিল মাতৃদেবতা।’ নারী মুক্তি, নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায়, নারী শিক্ষার প্রবক্তারূপে তিনি কুমিল্লাতে বেশ কিছু কাজ করেছেন।
ড. আখতার হামিদ খান
থানা টেইনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি পল্লি উন্নয়ন ভাবনার আরও এক রক্তিম পালক যুক্ত করেছিলেন। সেন্টার অন ইনটেগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক এবং কুমিল্লা পল্লি উন্নয়ন একাডেমির পরিচালক মো. আজিজুল হক, ড. আখতার হামিদ খান সম্পর্কে চমকপ্রদ ঘটনার বর্ণনা দেন। মো. আখতার হোসেন খানের বইয়ের ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়, একবার গ্রামের এক সভায় এককৃষক উঠে দাঁড়িয়ে ড. আখতার হামিদ খানকে বলল, ‘আমাকে কিছু ঋণ দিন’। শুনে ড. আখতার হামিদ খান বললেন, আমি কোথা থেকে আপনাকে ঋণ দেব? আপনাদের নিজেদের আমানতের যে পয়সা সঞ্চিত আছে সে পয়সা থেকেই ঋণ নিন, কবে নেবেন তা আপনারা বসে ঠিক করে নেন। আর এক সভায় কয়েক জন কৃষক উঠে দাঁড়িয়ে বলল,‘আমরা গরিব আমাদের ঋণ দেন।’ ড. আখতার হামিদ খান বললেন, আপনারা গরিব বলেই তো আপনাদের দরকার সঞ্চয় করে সঞ্চয়ের অর্থ আপনাদের গ্রুপের ফান্ডে রাখার। আর একজন দাঁড়িয়ে বলল, আপনাদের ঋণ আপনি মাফ করে দেন। তিনি বললেন, ‘এটা তো আমার পয়সা না, আপনাদেরই জমানো পয়সা থেকে আপনারাই ঋণ নিয়েছেন, সে পয়সা আমি কী করে মাফ করে দেব?’ ১৯৫৯ সালে কৃষকদের নিজেদের সঞ্চয় আমানতের পথ ধরে যে গ্রামভিত্তিক কো-অপারেটিভ তৈরি হলো এবং যেদিন কোনো ক্ষুদ্র কৃষক কো-অপারেটিভের সে ফান্ড থেকে প্রথম ঋণ নিল সেদিন থেকেই শুরু হলো মাইক্রোক্রেডিটের শুভযাত্রা।
বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি, কুমিল্লার প্রধান নির্বাহী পরিচালক আজিজুল হক ড. আখতার হামিদ খানের সঙ্গে একত্রে দীর্ঘ দিন কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। তিনি স্মৃতিচারণে বলেন, ‘ক্লাসে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই দেখতাম কলেজের সামনে দিয়ে একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, ইয়া উঁচু শরীর, হলুদের মতো গায়ের রঙ, সারস পাখির মতো উঁচু নাক। শিক্ষকদের কেউ কেউ বলতেন, তিনি আইসিএস পাস ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে বড় চাকুরে। কেউ বলতেন, তিনি ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা কোর্টে বসে বিচার করেন।’ কিন্তু আমরা জানতাম তিনি আখতার হামিদ খান, একজন মুসলমান বড় অফিসার, বুকটা গর্বে ফুলে উঠত।
আমাদের দেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রতিফলিত হয়েছে। অবহেলিত মানুষের জন্য ভাবনা তার দেহ ও মনকে অসহায় করে তুলেছে। তাই তিনি পল্লি উন্নয়নের জন্য ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন দেশপ্রেমিক। পল্লি উন্নয়নের এই অকুতোভয় সৈনিকের জীবনাবসান ঘটে ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর। কীর্তিমানের কখনো মৃত্যু ঘটে না, তিনি এখনো জীবন্ত হয়ে রয়েছেন তার প্রতিটি কর্মের মধ্যে দিয়ে। পল্লির মানুষের জন্য তার ভাবনার প্রথম ধাপটিই তিনি রেখেছেন কুমিল্লা পল্লি উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এটিই তাকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। আজ বিস্ময়ে অবিভূত হতে হয় কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত পল্লি উন্নয়ন একাডেমি নিয়ে।
ড. আখতার হামিদ খানের সুচিন্তিত চিন্তার বিকাশ ও তার সফলতা আমরা বর্তমানে পল্লি উন্নয়ন একাডেমির সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে দেখতে পায়। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত একাডেমি এগিয়ে চলছে একটা দর্শন বা আদর্শ নিয়ে এটা তার গতিধারা বজায় রাখছে এবং রাখবে এটাই প্রত্যাশা। গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জল, জমি, জনতা এটার সঠিক ব্যবহার এখন জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছি। ছদ্ম বেকারত্বকে ঝরিয়ে ফেলতে হবে বেশি মাত্রায়। গ্রামের মানুষের সমস্যা সমাধানে সুদূরপ্রসারী গবেষণা জরুরি যা পল্লির মানুষের দারিদ্র্য নিরসনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
গ্রামের মানুষকে কাছে টানার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ড.আখতার হামিদ খানের। তার প্রখর পাণ্ডিত্য, নিম্ন আয়ের অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের কৃষি সমাজের প্রতি অবদান তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। দেশব্যাপী পল্লি প্রশাসনের ক্ষেত্রে জাতিগঠনমূলক বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং তৃণমূল পর্যায়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে বার্ড এর ভূমিকা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়ন বিষয়ক প্রকাশনার ক্ষেত্রে এটি একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। বার্ড অনেকগুলো সফল পল্লি উন্নয়ন মডেলের উদ্ভাবক। ড. আখতার হামিদ খানের স্বপ্নে ঘেরা পল্লি উন্নয়ন একাডেমি ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন এলাকায় সফল প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করবে সেটাই প্রত্যাশা রাখি।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ ও গবেষক
এসএন