মারাকেশ চুক্তি কী খায়, না পিন্দে?
২৭ সেপ্টেম্বর ছিল মঙ্গলবার। সকালে ঘুম থেকে উঠে ইমেইল খুলে প্রথমেই একটি চমৎকার সংবাদ পেলাম। প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক আন্দোলনের এক অদম্য সৈনিক, প্রিয় অনুজ ভাস্কর ভট্টাচার্যের মেইল। বাংলাদেশ অবশেষে মারাকেশ চুক্তি অনুসমর্থন করেছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত খুশির খবর। তবে খবরটি নিয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ এবং তাদের নিয়ে কর্মরত মানুষের মধ্যে যেমন আনন্দের বন্যা বইছে, দেশের কোনো পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে কোনো খবর চোখে পড়ল না। এ ব্যাপারে কিছুটা মন খারাপ হলেও অবাক হইনি, কষ্টও পাইনি। প্রতিবন্ধী মানুষদের ব্যাপারে আমাদের দেশের মূলধারার মিডিয়া হাউজগুলোর নির্লিপ্ততা তো আর নতুন বিষয় নয়। এ দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে।
তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, মারাকেশ চুক্তি আসলে কী? এটি কী খায়, না পিন্দে? এটি অনুসমর্থন করলে কার কিইবা উপকার হবে। এই চুক্তি নিয়ে অনেকের কিছু প্রশ্নের কারণেই আমার এই দীর্ঘ পোস্ট। যারা কষ্ট করে পুরোটা পড়বেন, আশা করি এ সংক্রান্ত দ্বিধাগুলো দূর হবে।
প্রথমেই আসি মারাকেশ শব্দটি নিয়ে। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো কারণ নেই। মারাকেশ হলো উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মরক্কোর চতুর্থ বৃহত্তম শহর। ঐতিহাসিকভাবে অনেক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী একটি শহর। ইংরেজিতে Marrakesh বা Marrakech, দুভাবেই লেখা হয়। এই শহরেই ২০১৩ সালে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের বই পড়ার সুবিধার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল, সেটিই মারাকেশ চুক্তি নামে পরিচিত।
বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থা বা World Intellectual Property Organization (WIPO) এর তত্ত্বাবধানে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, তাদের সদস্যরাষ্ট্রে ব্যবহারের জন্য। সংক্ষেপে Marrakesh Treaty বলা হলেও চুক্তিটির পুরো নাম হলো Marrakesh Treaty to Facilitate Access to Published Works for Persons Who Are Blind, Visually Impaired or Otherwise Print Disabled অর্থাৎ, যে মানুষদের দৃষ্টিহীনতা বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা রয়েছে, বা ছাপানো কোনো কিছু পাঠ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তাদের জন্য মুদ্রিত যেকোনো প্রকাশনা পাঠোপযোগী করার সুবিধার্থে মারাকেশ শহরে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি।
মেধাস্বত্ব মানে কী?
মেধাস্বত্ব বা কপিরাইট হলো বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান একটি আইনি অধিকার, যাতে কোনো মৌলিক সৃষ্টিকর্মের মূল সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কোনো পক্ষ সেই সৃষ্টিকর্ম ব্যবহার করতে পারবে কি না, বা পারলে কোন কোন শর্তে ব্যবহার করতে পারবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ব্যাপারে ওই মূল সৃষ্টিকর্তাকে একক ও অনন্য অধিকার দেওয়া হয়। এগুলো হতে পারে বই, সাহিত্য, গল্প, ছড়া, আঁকা ছবি, ফটোগ্রাফ, প্রকাশনা, ভিডিও, সিনেমা, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি নানা কিছু।
এবার আসি এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনের কারণে। পৃথিবীতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বইপত্র বা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর কোনোটি হয়তো থাকে পাঠ্যক্রমের বই, কোনোটি আবার সাহিত্য নিয়ে। অনেক বই কিছু কিছু দেশে বা বিশ্বব্যাপীও ‘বেস্ট সেলার’ হয়। আবার নিউজ উইক, টাইমস বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মতো বিশ্বনন্দিত পত্রিকাও ছাপা হয়। এরকম যত প্রকাশনা হয়, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই তো সুরক্ষিত থাকে কপিরাইটের মাধ্যমে। অর্থাৎ, এই প্রকাশনাগুলো যে কেউ চাইলেই ফটোকপি করে বা স্ক্যান করে বিক্রি করতে পারবে না। কপিরাইটে সুরক্ষিত প্রতিটি প্রকাশনাতেই লিখিত থাকে, লেখক বা প্রকাশকের লিখিত অনুমতি ছাড়া বইটিকে অনুবাদও করা যাবে না, ইলেকট্রনিক বা অন্য কোনো ভার্সনে স্টোরেজও করা যাবে না। বইগুলোর শুরুর দিকেই সাধারণত লেখা থাকে:
No part of this publication may be reproduced, stored in a retrieval system, or transmitted in any form or by any means, electronic, mechanical, photocopying, recording, or otherwise, without written permission of the publisher.
প্রতিটি দেশের কপিরাইট আইন অনুযায়ী এই কাজগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশেও কপিরাইট আইন ২০০০ অনুযায়ী এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এগুলো অমান্য করলে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা এবং চার বছরের জেলও হতে পারে।
সমস্যা হলো, বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে প্রায় ২৮ কোটি। তাদের সবাই যে পড়ালেখা জানে, তা নয়। তবে যারা জানে, তারা পড়ালেখা করে সাধারণত ব্রেইল পদ্ধতির মাধ্যমে। কিন্তু এই বইপত্রগুলো তো মূল প্রকাশক আর ব্রেইলে মুদ্রণ করে না। World Blind Union এর তথ্য মতে বিশ্বের যত পাবলিকেশন হয়, তার সর্বোচ্চ মাত্র ৭ শতাংশ পাবলিকেশন হয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য পাঠোপযোগী করে। তাহলে শিক্ষিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা চাইলেও কি বাকি বইগুলো পড়তে পারবে না? রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী, হুমায়ূন আহমেদের হিমু বা বারাক ওবামার A Promised Land… এগুলো পড়ার অধিকার কি তাদের নেই? প্রকাশক যেহেতু ব্রেইল ভার্সন মুদ্রণ করছেন না, কপিরাইটে সুরক্ষিত এই বইগুলোর ব্রেইল ভার্সন করতে গেলে তা হবে কপিরাইট আইনে অপরাধ। তাহলে উপায়?
এই উপায়টিই হলো মারাকেশ চুক্তি। কপিরাইটের মাধ্যমে যে বই বা পত্রিকাগুলো সুরক্ষিত আছে, সেগুলোর কপিরাইটে কিছুটা শিথিলতা আনা, যেন বইগুলোকে দৃষ্টিহীন বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য পাঠোপযোগী করা যায়।
কীভাবে তা হবে? বইগুলোকে ব্রেইল ভার্সনে কনভার্ট করা যাবে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের কেউ কেউ কিন্তু কম্পিউটার ব্যবহারে পারদর্শী। কম্পিউটারের স্ক্রিনে যা আছে, তা পড়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ কিছু সফটওয়্যার আছে, এগুলো ব্যবহার করে তারা দিব্যি পড়ালেখা করতে পারে। এই বইগুলো ইলেক্ট্রোনিক ফর্মে কনভার্ট করা গেলে কম্পিউটারে, ট্যাবে বা মোবাইল ফোনে এই বইগুলো পড়া যাবে। অডিও বুক বানানো যাবে, যেন যখন তাদের ইচ্ছা, তারা বইগুলো নিজেরাই পড়তে পারবে, শুনতে পারবে। অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না, অন্য কাউকে পড়ে শোনাতে হবে না। বইপত্রের এই কনভার্সন করা বা স্টোরেজ করা এখন আর আইনের পরিপন্থী হবে না।
কপিরাইট আইনে যে বইপত্রগুলো সুরক্ষিত থাকে, মূলত দুইভাবে সরক্ষা হয়। একটি হলো মেধাস্বত্ব, অর্থাৎ একজনের লেখা চুরি করে অন্য কেউ নিজের নামে চালিয়ে দিতে পারবে না। অন্যটি হলো আর্থিক সুরক্ষা, অর্থাৎ পাইরেটেড কপি বিক্রি করে মূল প্রকাশকের পরিবর্তে অন্য কেউ ব্যবসা করতে পারবে না।
মারাকেশ চুক্তি অরিজিনাল প্রকাশনার পাঠোপযোগী ভার্সন তৈরি করার সুবিধা দান করলেও এই সৃষ্ট ভার্সনগুলো কিন্তু যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। এই কনভার্সনগুলোও হতে হবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এবং এগুলো কেবল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্যই প্রাপ্তব্য হবে। এই নিয়মনীতিগুলোও এই চুক্তির অংশ।
WIPO এর অধীনে সদস্য দেশের সংখ্যা হলো ১৯৩টি। অর্থাৎ, এই ১৯৩টি দেশে কপিরাইট আইন আছে। বাংলাদেশও এর অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে বাংলাদেশ অনুসমর্থন করলো মারাকেশ চুক্তি। এর মাধ্যমে আমরা এই চুক্তিটির শরিক রাষ্ট্র হলাম। চুক্তিটির নিয়মানুযায়ী অনুস্বাক্ষরের চিঠি WIPO এর প্রধান কার্যালয়ে জমা দেওয়ার তিন মাস পর, অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ এই চুক্তিটি বাংলাদেশে কার্যকর হবে। ২০১৩ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর ২০১৪ সালে প্রথম শরিক রাষ্ট্র হয়েছিল ভারত। আমরা সম্ভবত ৯০তম শরিক রাষ্ট্র হলাম।
অনুসমর্থন করার অর্থ কী?
পৃথিবীর যেকোনো দেশ অন্য আর কোনো দেশের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক, আইনি বা যেকোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করতেই পারে। কিন্তু জাতিসংঘ বা এধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিশ্বের নানাধরনের বিষয় নিয়ে সময়ে সময়ে নানা ধরনের আইনি কাঠামো, চুক্তি, ডিক্লারেশন, সনদ বা কনভেনশন ইত্যাদি প্রণয়ন করে। সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই দলিলগুলোর সঙ্গে শরিক হবে কী হবে না, এই সিদ্ধান্তগুলো একান্তই থাকে দেশগুলোর উপরে। কয়েকটি ধাপে এই দেশগুলো শরিক হতে পারে।
প্রথম ধাপটি হলো সিগনেটরি হওয়া, বা সিগনেচার করা। এটিকে বাংলায় বলা হয় স্বাক্ষর করা। এর অর্থ দাঁড়ায়, সদস্যরাষ্ট্র এই চুক্তি বা দলিলটিকে একটি প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু এটি মেনে চলতে বাধ্যবাধকতা ঘোষণা করছে না।
পরের ধাপটি হলো র্যাটিফিকেশন করা, যাকে বাংলায় কেউ বলে অনুস্বাক্ষর করা, কেউ বলে অনুসমর্থন করা। এর অর্থ হলো, সদস্যরাষ্ট্র চুক্তি বা দলিলটিকে পুর্নভাবে গ্রহণ করছে এবং নিজ দেশে পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে অঙ্গিকার করছে। অনুসমর্থন বা অনুস্বাক্ষর করলে সদস্য রাষ্ট্রটিকে তখন এই চুক্তি বা দলিলের শরিকরাষ্ট্র (State Party) বলা হয়।
অধিকাংশ দেশ আগে স্বাক্ষর করে কিছুটা সময় নেয়, পরে গিয়ে অনুসমর্থন করে। কোনো কোনো দেশ স্বাক্ষর এবং অনুসমর্থন একসঙ্গেই করে বসে। আবার কোনো কোনো দেশ চুক্তিটি স্বাক্ষর না করে বরং সরাসরি অনুসমর্থন করে দেয়। এই শেষ প্রক্রিয়াটিকে বলে Accession করা। এটির কোনো যুতসই বাংলা প্রতিশব্দ আছে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে মারাকেশ চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিন্তু স্বাক্ষর করার জন্য আর অপেক্ষায় না থেকে সরাসরি অনুসমর্থন, অর্থাৎ অ্যাক্সেশন করেছে। এতে যে আমাদের মান কমেছে, তা কিন্তু নয়। অনুসমর্থনই যখন আসল বিষয়, স্বাক্ষর করলেও কী আর না করলেই বা কী, কিছু এসে যায় না।
সব শেষ ধাপটি হলো, চুক্তিটি নিজ দেশে সুচারূভাবে বাস্তবায়ন করা। একটি দেশ যখন শরিকরাষ্ট্র হয়ে যায়, তখন সেই চুক্তি বা দলিলটি সেই দেশের নিজস্ব যেকোনো আইনের সমমর্যাদা পায়। তবে এগুলো যেহেতু আন্তর্জাতিক আইনি দলিল, এর সবকিছুই যেসব দেশে প্রযোজ্য হবে এমন কথা নেই। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ঐতিহ্যগত এমন নানা ধরনের আচার ব্যবস্থাই তো একেক দেশে বিচরণ করে। কাজেই আন্তর্জাতিক আইনি দলিলের সব কিছুই যে সব দেশে খাপ খাবে, এমন কথা নেই। এজন্য প্রত্যেকটি দেশকে এই দলিলগুলোর মুলনীতি এবং প্রধান প্রধান বিষয়গুলোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশীয় আইন বানিয়ে নিতে হয়, বা বিদ্যমান আইন সংশোধন বা পরিমার্জন করতে হয়। যে কারণে অধিকাংশ উন্নত দেশ আগে স্বাক্ষর করে, তারপর তাদের দেশের সংশ্লিষ্ট আইন পরিবর্তন করে, এর পরে গিয়ে অনুসমর্থন করে। উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত তা করে না। আগে স্বাক্ষর, তারপর অনুসমর্থন, তার পরে গিয়ে আইন তৈরি বা পরিবর্তন। বাংলাদেশ হলো এই পরের দলে। এর পরের পদক্ষেপ কী হবে? স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে কপিরাইট আইন পরিবর্তন বা পরিমার্জন করতে হবে এবং প্রকাশনার কনভারসনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
স্বাক্ষর বা অনুসমর্থনের সিদ্ধান্ত কে নেয়?
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি একেক দেশে একেক রকম। কোনো কোনো দেশে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান এই সিদ্ধান্তটি একাই নেন। আমেরিকায় যেমন, তাদের প্রেসিডেন্ট এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকেন। কোনো কোনো দেশে এই সিদ্ধান্তটি নেয় জাতীয় সংসদ, যেমন পাকিস্তান। আবার কোনো কোনো দেশে এই সিদ্ধান্তটি নেয় মন্ত্রিপরিষদ। বাংলাদেশ ও ভারতে এভাবেই এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়।
স্বাক্ষর বা অনুসমর্থনের প্রক্রিয়া কী?
বাংলাদেশের মন্ত্রীপরিষদে কোনো আন্তর্জাতিক আইনি দলিল স্বাক্ষর বা অনুসমর্থনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সিদ্ধান্তটি জানানো হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধান বরাবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে একটি চিঠি লিখেন এবং এই চিঠির কপি মন্ত্রীর পক্ষে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হস্তান্তর করেন। ওই দপ্তরে দলিলটিতে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনের জন্য দুটি পৃথক নিবন্ধন বই থাকে, সেই বইতে দেশের পক্ষে স্থায়ী প্রতিনিধি স্বাক্ষর করেন। ব্যস, প্রক্রিয়া শেষ।
কোনো কোনো দলিলের কার্যালয় জাতিসংঘের মূল দপ্তরে নিউ ইয়র্ক শহরে থাকে, স্বাক্ষর সেখানেই করতে হয়। আবার কোনোটি হয়তো থাকে জেনেভাতে, সেটি জমা দিতে হয় ও স্বাক্ষর করতে হয় সেখানে। মারাকেশ চুক্তির হোতা যেহেতু বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থা (WIPO), যার সদর দপ্তর জেনেভায়, এই অনুসমর্থনের চিঠি সেখানেই জমা দিয়ে স্বাক্ষর করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে তো ব্যাপক শক্তপোক্ত আইন আছে, যেগুলোর বাস্তবায়ন নেই। কপিরাইট আইনেরও কেউ ধার ধারে না। বইয়ের পাইরেটেড ফটোকপি রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিক্রি হয়। সিডি-ডিভিডির পাইরেটেড কপি দিয়ে বাজার সয়লাব। নীলক্ষেতে যেকোনো বইয়ের ফটোকপি চাইলেই পাওয়া যায়। তাহলে এ নিয়ে এত প্যাড়া কেন?
দুঃখজনক হলেও কথাগুলো খুবই সত্য। আবার এও সত্য, কোনো কোনো আইন হঠাৎ করেই আবার বাস্তবায়ন হয় এবং রুই-কাতলারা পালিয়ে গেলেও পুঁটিমাছগুলো ঠিকই ধরা পড়ে যায়। তাদের তখন বিপদের আর শেষ থাকে না। প্রতিবন্ধী মানুষ এমনিতেই তো নানা বঞ্চনার শিকার, শোষণের শিকার, অবহেলার শিকার। খামোখা আইন ভেঙে নিজেদের ঘাড়ে আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে কে চায়? আর এই কনভারসনগুলো যে খুব সস্তায় করা যায়, বা খুব সহজে করে ফেলা যায়, তাও তো নয়।
তাহলে বাংলাদেশের এই অনুসমর্থন কি খুব খুশির খবর?
অবশ্যই খুশির খবর। বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থা অনেক পুরোনো হলেও ১৯৭৪ সাল থেকে এটি জাতিসংঘের একটি অঙ্গসংগঠন। তাদের আওতাধীন এই চুক্তির দুই ধরনের অংশ আছে। একটি হলো দেশের ভেতরে সুযোগ সুবিধা নিয়ে, অন্যটি হলো আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ এই চুক্তিতে শরিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে এই দেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা শুধু যে এই দেশে উৎপন্ন বইপত্র পড়তে পারবে, তা নয়। সব শরিকরাষ্ট্রে উৎপন্ন বইপত্রে পাঠযোগ্যতা পাবে। একইসঙ্গে এই দেশে উৎপন্ন মানসম্মত কাজগুলো অন্যান্য দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের কাছে উন্মুক্ত হবে।
বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার অধীনে Accessible Books Consortium (ABC) নামে একটি পাবলিক-প্রাইভেট সংস্থা আছে। মারাকেশ চুক্তির শরিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ এবং তাদের সংগঠনগুলো ABC-এর সব কর্মকাণ্ডে যোগদানের পূর্ণ সুযোগ পাবে। ABC সাধারণত চার ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে।
ABC Global Book Service – এটি একটি অন-লাইন ক্যাটালগ, যার মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের সহযোগিতা করে, এমন লাইব্রেরিগুলো বিভিন্ন বইয়ের ডিজিটাল ভার্সন চাইতে পারে। অন্যান্য দেশের লাইব্রেরিগুলোর সঙ্গে বিনামূল্যে বই আদান-প্রদানের একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে।
Accessible publishing – যেসব প্রকাশনা সংস্থা যেকোনো বই মুদ্রণের শুরু থেকেই বইগুলোকে সবার জন্য পাঠযোগ্য করার প্রয়াস যদি নিতে চায়, তাদের এসংক্রান্ত যেকোনো ধরনের কারিগরি সহযোগিতা তো বিনামূল্যে প্রদান করেই, উপরন্তু প্রতি বছর সেরা প্রকাশকদের জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারও প্রদান করে।
Capacity building – উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কপিরাইটভুক্ত বইগুলোর পাঠযোগ্য কনভারসন করার জন্য উৎসুক সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষার স্তরের বইয়ের কনভারসনের খরচ বহন করার জন্য যাবতীয় ফান্ডিংও প্রদান করে।
Websites offering accessible books – বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে যেসব বইয়ের ডিজিটাল ভার্সন আছে, সেগুলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসে ABC নামের সংস্থাটি। এই সুবিধাগুলোর দ্বার উন্মোচন হলো এই অনুসমর্থনের মাধ্যমে। এটি কি খুশির খবর নয়?
বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হবে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তিটি অনুসমর্থন করা জন্য। এর মধ্য দিয়ে এই দেশের প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার নিশ্চিতকল্পে অবশ্যই একটি বড় মাইলফলক অতিক্রম করা হলো।
তবে এই সিদ্ধান্তটি তো আর এমনি এমনি আসেনি। অসংখ্য মানুষের এবং সংগঠনের প্রায় এক দশকের আন্দোলনের ফসল এই অনুসমর্থন। ধন্যবাদ তাদের প্রাপ্য, এভাবে লেগে থাকার জন্য। ধন্যবাদ প্রাপ্য দাতা সংগঠনগুলোর, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে এসেছে। আজ সকলের একটি বিজয়ের দিন। আনন্দ-উল্লাসের দিন।
তবে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার নামতে হবে মাঠে। একটি সমরক্ষেত্রে জয় পাওয়া গেল, যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। মারাকেশ চুক্তি অনুসমর্থন হলো, এবার বাস্তবায়নের পালা।
এসএন