দেশে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার বিস্তার
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি ও প্রসারের সাথে প্রায় সমান্তরালভাবেই অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সারা বিশ্বে এটি একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। যে দেশের অর্থনীতির আকার বড় বা যে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উচ্চস্তরের, সে দেশে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার ব্যপ্তিও বিশাল। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা এ কারণেই প্রসার ও সেইসাথে গভীরতা লাভ করেছে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার অর্থনৈতিক সংবাদ, তা সে যে মাধ্যমেই হোক না কেন, পাঠ ও পর্যালোচনা করলে চিত্রটি পরিষ্কার ভাবে ভেসে উঠে। আবার যে দেশের অর্থনীতি আকারে ছোট এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর ছোট, সেসব দেশে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতাও স্বল্প পরিসরে সীমাবদ্ধ। সে সব দেশের সংবাদ মাধ্যমের দিকে নজর দিলে তা বোঝা যায়।
আমাদের দেশ যখন পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিলো তখন এখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিলো সীমিত পরিসরের। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে ছিল পাট শিল্প, চা শিল্প ও অন্যান্য বিভিন্ন ছোট খাটো শিল্প থেকে উৎপাদন ও সেগুলো বিপনন। বস্তুত শিল্প বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত সকল কিছুই নিয়ন্ত্রিত হতো করাচি বা ইসলামাবাদ থেকে। নীতি বিষয়ক সমস্ত কিছুর সিদ্ধান্ত হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। যে কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিলো সীমিত আকারের। একই কারণে এই প্রদেশে অর্থনৈতিক সংবাদ সৃষ্টি হতো খুবই কম। শুধুমাত্র ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় অবস্থিত শিল্প কেন্দ্র ও সিলেটের চা উৎপাদন সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড থেকে সৃষ্ট সংবাদ কোনভাবেই অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার বৃদ্ধির জন্য বা তা প্রসারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে, তৎকালিন সময়ে যে কয়েকটি সংবাদপত্র এই প্রদেশ থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতো সেগুলোতে অর্থনৈতিক সংবাদ উল্লেখযোগ্য স্থান পেতো না। নারায়নগঞ্জ, দৌলতপুর এবং চট্টগ্রামে, পাট ও চা সংক্রান্ত যে দৈনন্দিন ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড হতো সেগুলো খুব সীমিত আকারে ছাপা হতো। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ নিয়মিতভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও তা খুবই সীমিতসংখ্যক বিনিয়োগকারীর উৎসাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। সংক্ষেপে এই ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চিত্র।
কৃষি বর্তমানের মত তখনও প্রধান কর্মকাণ্ড ছিলো অর্থনৈতিক দিক থেকে। তবে তা স্বাভাবিক ভাবে যতখানি গুরুত্ব পাওয়ার প্রয়োজন ছিলো ততখানি গুরুত্ব অর্থনৈতিক সাংবাদিকতায় পায়নি। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য হিসাবে তেল, চিনি, লবন, পেঁয়াজ সংক্রান্ত সংবাদ পত্রিকায় স্থান পেতো। তবে সেই সমস্ত সংবাদ সাধারণ সংবাদ হিসাবে পত্রস্থ হতো এবং সেগুলো দাখিল করতেন সাধারণ বিষয়ক রিপোর্টাররাই। কোন বিশেষায়িত রিপোর্টার বাজার দরদামের উপর রিপোর্ট করতেন না। সরাসরিভাবে বলা যেতে পারে তৎকালীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সীমানা খুবই ছোট হওয়ার কারণে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর বিশেষ রিপোর্ট হতো না। সুযোগও ছিল না। তবে দুই একটি পত্রিকায় অর্থনীতির ছোট- খাটো বিষয়ের উপর কোন কোন রিপোর্টার রিপোর্ট করতেন পত্রিকা কর্তৃপক্ষ দ্বারা আদিষ্ট হয়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পরের দশ বছরেও অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা আগের মতই সীমাবদ্ধ ছিলো একই কারণে। সেই সময়টা ছিল প্রধানত পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভঙ্গুর ছিল এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পূর্বে, স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যা অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারতো, অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা পরিস্ফূট হতে পারেনি এবং প্রসার লাভ করেনি। তবে দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে শুরু করে আশির দশকের প্রথমার্ধ থেকে। সেই সময় দেশের অর্থনীতিকে খুলে দেয়া হয় অর্থাৎ ওপেন করে দেয়া হয় নীতিগত পরিবর্তন এনে। ফলে ব্যক্তি পুঁজি খাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমদানি এবং রপ্তানি দুটোই বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উদ্দ্যোক্তরা বিনিয়োগ শুরু করেন। সরকারও ক্রমাগতভাবে সহায়তা দিতে থাকে। নতুন কলকারখানা সৃষ্টি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন শুরু হয়। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের চিত্র পাল্টাতে থাকে। সেই সঙ্গে অর্থনীতির প্রতিটি খাত-উপখাতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। একটু ধীরে হলেও ক্রমাগতভাবে অর্থনৈতিক রিপোর্টের পরিসীমা বাড়তে থাকে।
উদ্যোমশীল, মেধাসমৃদ্ধ যুবকেরা অর্থনৈতিক রিপোর্টার হিসাবে তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করেন। দেখতে দেখতে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর পত্রিকা প্রকাশ হতে শুরু করে। পূর্ব থেকেই বিদ্যমান পত্রিকাগুলো অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর জোর দিতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে যে সমস্ত পত্রিকায় আগে অর্থনীতি সংক্রান্ত রিপোর্ট তেমন গুরুত্ব পেত না, সেই সব পত্রিকায় অর্থনৈতিক রিপোর্ট ভালোভাবে স্থান পেতে থাকে। অর্থনৈতিক রিপোর্ট তৈরিতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে অধিকতর সংখ্যায় নতুন নতুন রিপোর্টার তৈরি হয়। এই অবস্থার আরো উন্নত হয় পরবর্তি বছরগুলোতে। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রথমার্ধ থেকে নতুন টেলিভিশন চ্যানেল সাংবাদিকতার কর্মক্ষেত্রে বা ডোমেনে আসতে শুরু করে এবং তারাও অর্থনৈতিক সংবাদকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে থাকে। যা এখনো অব্যাহত আছে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, বর্তমানে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতায় যে ব্যপ্তি বা প্রসার ঘটেছে তা হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারের ফলেই।
বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরো দেশ জুড়েই চলছে। অর্থনীতির সকল খাত ও উপখাতে কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার সুযোগ বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে প্রচুর অর্থনৈতিক রিপোর্ট বা প্রতিবেদন প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আসছে। বহু দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা এবং অনলাইন মাধ্যম প্রায় সম্পূর্ণ ভাবেই অর্থনৈতিক সাংবাদিকতায় নিজেদেরকে নিবেদিত করেছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বেশি পরিমানে অর্থনৈতিক রিপোর্ট প্রচার করে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংবাদের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক এবং অনলাইন মাধ্যমের সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে তাদের সংখ্যা যে প্রচুর সে বিষয়ে কোন মহলেই দ্বিমত নেই। জানামতে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্চ বা ক্যাপিটাল মার্কেটের কর্মকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে কয়েক ডজন অনলাইন নিউজ পোর্টাল চলছে। এ থেকেই ধারণা করা যায় দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার কতদূর বেড়েছে।
বর্তমানে এইসব সংস্থায় যারা অর্থনৈতিক রিপোর্ট করছেন তাদের প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষিত এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। এঁদের সবাই উদ্যোমি ও মেধা সম্পন্ন। রিপোর্টে তাদের মেধার প্রমান পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, এই সমস্ত রিপোর্টারদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব কাজ করছে। তাঁরা অন্যের চাইতে বেশি ভালো রিপোর্ট দাখিল করতে অত্যন্ত পরিশ্রম করছেন এবং কত সুন্দর ও সাবলিলভাবে রিপোর্ট উপস্থাপন করা যায় সে বিষয়ে প্রচুর চিন্তাভাবনা করে রিপোর্ট তৈরি করছেন। প্রয়োজনে সিরিজ রিপোর্ট করছেন এবং দেশী- বিদেশী বিভিন্নসূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা নিজ রিপোর্টে সংযোজন করছেন। ফলে তাদের রিপোর্ট তথ্যবহুল ও আকর্ষনীয় হচ্ছে। তারা অবশ্যই কৃতিত্বের দাবীদার।
তথ্য-উপাত্ত, পটভূমি, ব্যাখ্যা এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভবিষ্যবাণী বা ফোরকাস্ট সংযুক্ত করার কারণে রিপোর্টগুলোর মান ক্রমশ উন্নত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বলা যায় আমাদের দেশে বাংলা ভাষায় দাখিলকৃত রিপোর্ট বর্তমানে উপমহাদেশের বাংলাভাষী অঞ্চলে অতি উচ্চমানের। এটা সম্ভব হয়েছে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার বা প্রতিবেদকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অনুসন্ধিৎশুমন ও বিষয়ের উপর পরিষ্কার ধারণা থাকার কারণে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য তারা দেশে-বিদেশে যে সমস্ত ট্রেনিং নিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার বা ঘটনা কভার করেছেন তা তাদের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে। দেশে এখন বেশ কিছু রিপোর্টার বা সংবাদ বিশ্লেষক আছেন যারা বিশ্ব অর্থনীতি সম্বন্ধেও ভালোমানের প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন এবং দেশে বিদেশে পুরষ্কার পেয়েছেন।
এ ছাড়া দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা কি রকম হওয়া উচিৎ, কোন কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন এবং কোন কোন আইন যুগোপযোগী করা দরকার সেই সব বিষয়ে মতামত দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। স্বল্প কথায় অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের এবং তাঁদের প্রদত্ত প্রতিবেদন সমুহের মান উচ্চপর্যায়ে পৌঁছেছে।
দেশে অর্থনীতির আকার এবং কর্মকাণ্ড আগামীতে আরো প্রসার লাভ করবে স্বাভাবিক নিয়মেই। ফলে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা প্রসার লাভ করবে। আরো নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত উপখাতের উপর প্রতিবেদন তৈরি করার। এই পরিস্থিতিতে রিপোর্টের মান ঠিক রেখে প্রতিবেদন দাখিল করার প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের ভেতরেও বৃদ্ধি পাবে। উৎকর্ষতা অর্জন একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া কোন স্থানে যেয়ে থেমে যায় না। বর্তমানে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা উৎকর্ষতার যে স্তরে পৌঁছেছে তা থেকে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করে বসে থাকার কারণ নেই।
লেখক: সাংবাদিক