পর্যটনে জাদুবাস্তববাদ
মানুষ কল্পনায় হাসে, কল্পনায় ভাসে, কল্পনায় সৃষ্টি করে। কল্পনাপ্রবণ মানুষ সৃষ্টির অগ্রদূত। মানুষের মধ্যে রয়েছে কল্পনার জাদু দিয়ে অন্যকে আকৃষ্ট করার বিশেষ ক্ষমতা। মানুষ তার কল্পনার রাজ্যে রাজা হয়, শাসন করে; আবার প্রজা হয়ে শাসিত হয়। কল্পনায় হারিয়ে যায়, নিজেকে বহুরূপে দেখে ও আবিষ্কার করে। কল্পনার রঙে আঁকে সুখ ও দুঃখের শিল্প, জীবন। মানুষের রয়েছে কল্পরাজ্য গড়ার বিলাসি সক্ষমতা। কল্পনার জাদুকরী ক্ষমতা তাকে নানাভাবে ক্ষমতায়িতও করে। জুল ভার্ন তার জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ প্রবন্ধে কিংবা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার ভবিষ্যতের মানুষ প্রবন্ধে যা লিখে গেছেন, তা কল্পনার সার্থক জাদুকরী উপস্থাপনা।
পর্যটনের রয়েছে কল্পরাজ্য তৈরির জাদুকরী ক্ষমতা। পর্যটনের ভাষায় যাকে আকর্ষণ বলে, তা আসলে জাদু। পর্যটক, বিনিয়োগকারী, গবেষক, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, সরকার সকলকে পর্যটন তার রাজ্যে আহবান জানায়। এই রাজ্য মোহময়, মধুময়, অনুপম ও শান্তির আঁধার। যারা এই ডাকে সাড়া দেয়, তারা লাভবান হয়। যারা পর্যটনকে ধরে রাখে, তারা সমৃদ্ধ হয়। কী ব্যক্তি, কী রাষ্ট্র সকলের জন্যই এটি সমানভাবে প্রযোজ্য। আজকাল বহু সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যটনের উপর ভর করে চলছে। পর্যটনের এই ডাক যারা শুনতে পায় না, তারা অচেতন-দূর্ভাগা।
পর্যটনের সঙ্গে যারা যারা যুক্ত থাকে, তারা সকলেই জাদুকর। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যাদুকর হলো পর্যটক। বাস্তবতার নিরিখে সুজনশীল আবেগের জাদুর কাঠি দিয়ে তিনি এর দৃশ্যমানতা ও উপভোগ্যতা প্রকাশ করেন। বিষয়বস্তুর উৎকর্ষ সাধনের মধ্য দিয়ে অভাবনীয়, অশ্রুতপূর্ব ও চমৎকার উপস্থাপনা তুলে ধরেন। তাতে কেবল অন্য পর্যটকই নয়, বরং বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী ও সরকারের নীতি নির্ধারকগণও নড়ে চড়ে বসেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন ভারত সফরকালে আগ্রার তাজমহল দেখে বলে উঠলেন যে, পৃথিবীর মানুষ আজ দুই ভাগে বিভক্ত: একদল যারা আগ্রার তাজমহল দেখেছেন ও একদল যারা দেখেননি। তার এই জাদুকরী বক্তব্য পরবর্তী চার মাসের মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে আগ্রায় হাজির করেছিল। রোমের কেলোসিয়াম, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার কিংবা কক্সবাজারের অবিচ্ছিন্ন বালুকাময় দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত প্রথমবার দেখার পর যে আবেগ আর উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়, তা নিশ্চয়ই অন্যদেরকে টেনে আনতে কম ভূমিকা পালন করে না। পর্যটকদের এসব কথা অন্যকে জাদুর মতো টানে। কারণ, এই তথ্যের মধ্যে রয়েছে জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপভোগের উপাদান যা বাস্তবতার জাদুতে মোড়ানো।
পর্যটনের প্রাকৃতিক দৃশ্যমান সম্পদগুলি পর্যটকদের মনস্তত্ত্বে বিশেষ দ্যোতনা সৃষ্টি করে। দৃশ্যপটের অনুপম রূপ ও বিশালতা তাকে মুগ্ধ করে। মানুষ মিশে যায় প্রকৃতিক রূপ-রস-গন্ধ-মায়ার সঙ্গে। আবেগ আর মুগ্ধতা এক হয়ে যায় জাদুকরী ভঙ্গিতে। তবে তা হয় বাস্তবতার ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান। অন্যদিকে, পর্যটনের অদৃশ্য সম্পদগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী। অপেরা, নৃত্য, সংগীত, যাত্রা, সিনেমা, আবৃত্তি ইত্যাদি পর্যটন সম্পদ আপন মহিমায় পর্যটকদেরকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যটকরা কেনাকাটা, ইভেন্ট, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, খাবার, ল্যান্ডস্কেপ ও প্রাকৃতিক মূলধন ইত্যাদি সম্বন্ধে জানতে ও দেখতে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে আসেন। উপভোগের সঙ্গে সমান তালে অর্জন করেন অভিজ্ঞতা। সাংস্কৃতিক বিনিময়, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ও নতুন মাত্রায় উপভোগ ও ভোগই প্রধান জাদু। ফলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধন এবং সামাজিক বিবর্তনের সূচনা ঘটে। তবে কেন এইসব জাদুকরী ঘটনা ঘটে, তার প্রকৃত কারণ এখনো মানুষের অজানা। বিজ্ঞানীগণ বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব (Chaos Theory) দিয়ে এসব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। সঙ্গে পালমা প্রপোজিশন ও বটম টেন থিওরি পর্যটনের জাদুর বাস্তবতা নির্ণয়ে যুক্ত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অর্থনীতি ও সামাজিক তত্ত্বগুলো এখানে যেমন কার্যকর, তেমনি ডাটা সায়েন্স, বক চেইন ও আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সও প্রাগ্রসর কৌশলে জায়গা করে নিচ্ছে।
আমরা জাদু দেখে হতবাক হই। পর্যটনেও হতবাক হই। জাদুর মহিমা ও কৌশল আমাদের উপর প্রবল ও প্রকট প্রভাব বিস্তার করে। পর্যটনেও একই ঘটনা ঘটে। পর্যটনের স্থাপনা, বিস্তার ও পরিবেশনা দেখে অন্তরে অন্তরে ভীষণভাবে আলোড়িত হই। তবে জাদুর সঙ্গে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায় না, জাদু ক্ষণস্থায়ী। পর্যটনের জাদু বাস্তবতার নিরিখে কল্পজগতের স্পর্শে রচিত ও প্রদর্শিত। তাই এর আবেদন দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থেকে যায় আমাদের জীবনে, মননে ও দর্শনে।
রেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম স্টাডিজ, ঢাকা