কোভিড ও ভিন্ন ভাবনা
ছেলেবেলায় রাজশাহী থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসছি। তখন যমুনা নদীর উপর ব্রীজ ছিল না, নগরবাড়ি-আরিচা ফেরী পার হয়ে আসতে হতো। আরও তিনটি ফেরী পার হয়ে ঢাকা শহরে এসে ঢুকতে হতো। ঘাটে ফেরী পেতে দেরী হবার কারণে, এবং বাসের চাকা পাঙ্কচার হবার কারণে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। চারিদিকে এখনকার মত আলো ঝলমলে ছিল না। সাভারের পর থেকে তো রীতিমত অন্ধকার জায়গা পার হয়েই আসছিলাম আমরা।এরইমধ্যে কন্ডাক্টর চিৎকার করে বলে যাচ্ছে গেন্ডা, হেমায়েতপুর, বলিয়ারপুর, আমিন বাজার…! বেশ মজা পেলাম, শুনে শুনে অন্ধকারের মধ্যেও নিজের অবস্থান জানতে পারছি এবং ক্রমশ ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বুঝে।
একদিন বাবা-মার সাথে অটোরিকশায় বেড়াতে যাবার পথে চমৎকার একটি গন্ধ টের পেলাম। বাবা বললেন, সামনে নাবিস্কো বিস্কুট ফ্যাক্টরি। রায়েরবাজারের কাছে গেলেই পেতাম তীব্র গন্ধ, বাবা বললেন এখানে অনেক ট্যানারী কারখানা আছে। খুব অল্প বয়সেই বুঝে নিলাম, শুধু চোখে দেখেই নয়, শব্দ শুনে বা গন্ধ শুঁকেও নিজের অবস্থান জানা যায়। ছাত্রজীবনে সিনেমা দেখার অভ্যাস ছিল। বিরতির সময় তীব্র এ্যামোনিয়ার গন্ধ শুঁকেই বুঝতে পারতাম টয়লেটগুলি কোনদিকে। সেই ৮০’র দশকে মফস্বল শহরগুলির সিনেমা হলগুলিতে তো আর এসি ছিল না। গ্রীষ্মকালে সেকেন্ড শো দেখতে গেলে গরম বাতাস আর আগের শো’র দর্শকের ঘামের আর্দ্রতায় পরিবেশ অসহ্য হয়ে যেত। হাতে পায়ের চামড়া কুটকুট করতো।
এখন বিয়েবাড়িতে দাওয়াতে গিয়ে গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারি মেন্যুতে পোলাও-রোস্ট খাওয়াবে, নাকি কাচ্চি বিরিয়ানী হবে! একইভাবে স্বাদ নিয়েই বলতে পারি, ফখরুদ্দিন বাবুর্চী নাকি ইকবাল ক্যাটারিং-এর কাচ্চি পরিবেশন করা হচ্ছে। আমের গন্ধ এবং স্বাদেই বলে দেয়া যায় ফজলী, হিমসাগর, ল্যাংড়া আর গোপালভোগের পার্থক্য! গরমে যখন হাত-পা জ্বালা করে, গাড়ীতে উঠেই ড্রাইভারকে বলি এসি ছেড়ে দিতে!
আমরা যারা দৃষ্টিশক্তির উপরই অনেক বেশী নির্ভরশীল, তারাও কিন্তু নাক, জিহবা, ত্বক এবং কান – এই বাকী চারটি ইন্দ্রিয়ের উপস্থিতি এবং এগুলির স্বয়ংক্রিয় ব্যবহারে অনেক বেশি অভ্যস্ত। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাবার সময় পর্যন্ত পাঁচটি ইন্দ্রিয় আমাদের অজান্তেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে। চলাফেরা করতে, কাজকর্ম করতে, এমনকি জীবনের নানা আনন্দকে উপভোগ করতেও দারুনভাবে ভুমিকা রাখে।
আজ থেকে প্রায় দু’বছর আগে, কোভিড যখন বিশ্বময় তান্ডব ঘটাতে আরম্ভ করলো, আমরা প্রথমেই জানতে পারলাম এর সহজ এবং প্রায় নিশ্চিত উপসর্গ হলো গন্ধ এবং স্বাদ, এই দুটি অনুভুতি কমে যাওয়া। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, তাদের একটি বড় অংশ সুস্থ্য হবার পরও বহুদিন এই দুটি ইন্দ্রিয়ের পুর্ণ সক্ষমতার অভাব অনুভব করেছে। অস্ট্রেলিয়ার একদল বিজ্ঞানী গবেষনায় বলেছেন, শুধু এই দুটি ইন্দ্রিয়ই নয়, অনেকের ক্ষেত্রে ত্বকের স্পর্শ বা তাপমাত্রা অনুভব করার ক্ষমতাও মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে কোভিডের কারণে, যা আমরা চক্ষুষ্মান মানুষেরা খুব একটা আমলে নেইনি।
আমরা যারা দৃষ্টিশক্তির উপরই বেশী নির্ভরশীল, এই তিনটি অনুভুতি যদি হ্রাসও পায়, সাময়িক কিছু সুখানুভুতি থেকেই হয়তো আমরা বঞ্চিত হবো। এগুলির অনুপস্থিতি আমাদের চলাফেরায় বা দৈনন্দিন কাজকর্মে হয়তো বা খুব বেশী প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু একটু ভাবুন তো সেই মানুষগুলির কথা, যাদের দৃষ্টিশক্তি নেই, তাদের উপর কোভিডের প্রভাব কেমন হবে?
বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা আনুমানিকভাবে প্রায় ৪০ লক্ষ। এর একটি বড় অংশ হলো সম্পুর্ণভাবে দৃষ্টিহীন, যারা আলো-আঁধারের তফাৎটুকুও বুঝতে পারে না। তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন বা চলাফেরায় এরা শ্রবন, গন্ধ এবং স্পর্শানুভুতির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। আবার, এদের একটি বড় অংশ বাস করে দারিদ্রসীমার নীচে। তাদের সবাই যে ভিক্ষা করে, তা নয়। অনেকেই ছোটখাটো চাকুরি, নানা হাতের কাজ বা ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত, যেগুলি দীর্ঘ লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে যারা চাকুরিতে ছিল, সবচাইতে আগে ছাঁটাই হয়েছে তারাই। হালাল রুটি-রুজির রাস্তা তো বন্ধই হলো, এর মধ্যে আবার যারা আক্রান্ত হলো কোভিডে, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন ও চলাফেরায় ফিরতে পারছে না, দুটি বা তিনটি ইন্দ্রিয় ভালোভাবে কাজ না করার ফলে। আমরা যারা দৃষ্টিমান, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছি এই মানুষগুলির কথা?
শ্রবণ-বাক প্রতিবন্ধী মানুষেরা নির্ভর করে ইশারা ভাষার উপর। এদের সবাই যে আনুষ্ঠানিক ইশারা ভাষা বুঝে, তা নয়। তৃণমূলে বেড়ে ওঠা শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষেরা পারিবারিকভাবে কিছু সহজাত ভাষা সৃষ্টি করে ফেলেছে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বা কথোপকথনের জন্য। এর অধিকাংশই হলো হাত বা আঙুলের পাশাপাশি মুখাবয়ব বা শরীরবৃত্তীয় নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ইশারা। আনুষ্ঠানিক ইশারা ভাষাও শুধুমাত্র আঙুল বা হাতের ইশারায় সীমাবদ্ধ নয়, মুখের নানা অঙ্গভঙ্গিও ইশারা ভাষার একটি বড় অংশ। অনেকেই আবার শিখেছে ঠোঁটের নড়াচড়া পড়তে শেখা, যাকে ইংরেজীতে বলে লিপ রিডিং। অধিকাংশ মানুষ যখন কোভিডের কারণে মাস্ক দিয়ে মুখমন্ডলের একটি বড় অংশ ঢেকে ফেলেছে, একটু ভাবতে পারেন কি এই মানুষগুলির পারষ্পরিক যোগাযোগের অবস্থা?
শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা একটু ভাবুন তো, যারা চোখেও দেখেনা, কানেও শোনে না, কথাও বলতে পারে না! বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষ। এরাও ইশারা ভাষা ব্যবহার করে, যা হলো হাতের স্পর্শের মাধ্যমে। এটিকে বলে স্পর্শ ইশারা ভাষা, বা ট্যাকটাইল সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। ছয় ফুট দুরত্বে থাকতে হলে, একে অন্যের সাথে হাতের স্পর্শ পরিহার করতে হলে এই মানুষগুলি বাঁচবে কিভাবে, ভাবতে পারেন?
প্রতিবন্ধী শিশুর নিয়মিত যত্নকারী মানুষটিকে যখন কোভিডের কারণে আইসোলেশনে থাকতে হয়েছে, একটু ভাবতে পারি কি, শিশুটির প্রতিটি দিন কিভাবে কেটেছে? মাসের পর মাস বন্ধ ছিল এদের স্কুল। অটিজম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা বা নানারকম শারীরিক প্রতিবন্ধিতাগ্রস্ত শিশুদের জন্য স্কুলগুলি তো শুধুমাত্র শিক্ষা দেয়ার প্রতিষ্ঠান নয়, অনেকেরই নিয়মিত থেরাপী গ্রহণেরও স্থান হলো তাদের স্কুল। অনলাইনে শিক্ষা দেয়া যায়, কিন্তু থেরাপী? এটি তো সকলেরই জানা, যে প্রতিবন্ধী শিশুদের যত তাড়াতাড়ি সঠিকভাবে সনাক্ত করা যাবে, এবং যত তাড়াতাড়ি সঠিক থেরাপীর আওতায় নিয়ে আসা যাবে, তাদের উন্নতি তত তাড়াতাড়ি হবে। অনেকেই তাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতাগুলি কাটিয়েও উঠতে পারে। শিশুদের মস্তিষ্ক যেভাবে বিকশিত হয়, তার উপর ভিত্তি করে বলা হয়ে থাকে, যে ৬/৭ বছর বয়সের মধ্যে থেরাপী আরম্ভ করতে না পারলে সীমাবদ্ধতাগুলি কাটিয়ে ওঠা দুরূহ হয়ে পড়ে। যে শিশুগুলি কয়েক বছর ধরে নিয়মিত থেরাপীর কারণে অনেকটাই তাদের সীমাবদ্ধতাগুলি সামলে নিতে শিখেছিল, মাসের পর মাস থেরাপী বন্ধ থাকার কারণে আবার তারা মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। অনেকের জন্যই আবার নতুন করে আরম্ভ করতে হবে, কিন্তু বয়স বেড়ে যাবার কারণে তারা হয়তো কখনই আর তাদের সীমাবদ্ধতাগুলি কাটিয়ে উঠতে পারবে না। মা-বাবারা ফোনে বা অনলাইনে থেরাপিস্টদের সাথে পরামর্শ করে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁরা তো আর প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট নন। ভাবতে পারেন কি এই পরিবারগুলির মানসিক যন্ত্রনার কথা?
প্রতিবন্ধী শিশুদের বাবা-মাকে নিয়মিতভাবে বলা হয়ে থাকে শিশুদের স্ক্রিন-টাইম কমানোর জন্য, কারণ এটি শিশুদের মানসিক বিকাশকে পর্যুদস্ত করে। একদিকে থেরাপী বন্ধ, অপরদিকে স্কুল চলেছে অনলাইনে। ঘরে বন্দী শিশুটিকে শান্ত রাখার জন্যই বাবা-মা বাধ্য হয়ে শিশুটিকে সেলফোন বা কম্পিউটারে ব্যস্ত রেখেছে দীর্ঘদিন। তাতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বিশাল সংখ্যক প্রতিবন্ধী শিশুর, আচরণে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা কি ভাবতে পারি আমরা?
মানসিক অসুস্থ্যতাজনিত প্রতিবন্ধী ছেলে বা মেয়েটি যখন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে, তার চিকিৎসা কোন হাসপাতালে পাওয়া যাবে, এ নিয়ে দিশেহারা বাবা-মায়ের কান্না শুনেছি আমরা কতজন? সবার তো আর আইসিইউ বেডের দরকার হয়নি, প্রয়োজন ছিল কেবল কোভিডের চিকিৎসা হয় এমন একটি হাসপাতালে একটি বেডের। কিন্তু মানসিক অসুস্থ্যতার কথা শুনেই ভর্তি করা হয়নি তাদের। কোভিড ব্যবস্থাপনায় এদের কথা কি একবারও ভাবা হয়েছিল?
কোভিডের মত বিশ্বজুড়ে অতিমারী একশো বছর পরপর এসেছে। ভাইরাসটিকে সম্পূর্ণভাবে হয়তো পরাস্ত করা যাবে না, হয়তো বা থেকেই যাবে বছরের পর বছর। বারবার মিউটেশন হয়ে নানা ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হবে। এরই মধ্যে অমেরিকা বা ইউরোপে আবার যেভাবে ছড়াচ্ছে আগের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে, আমাদের দেশেও পরিস্থিতি আবার খারাপ হবে না, তা তো আর নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সকলের সাথে প্রতিবন্ধী মানুষদের বিশেষ চাহিদাগুলির বিষয়টি আমাদের মূলস্বাস্থ্য পরিকল্পনায় থাকাটা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে, যা এতদিন ছিল না। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জরীপ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯.০৭% মানুষ কোনো না কোনো ধরণের প্রতিবন্ধী। অর্থাৎ, প্রায় দুই কোটি প্রতিবন্ধী মানুষ আছে এই দেশে। এত বড় সংখ্যক একটি জনগোষ্ঠীর বিশেষ প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলি কি মুলধারার জাতীয় পরিকল্পনার ভাবনা থেকে বাদ থেকেই যাবে?
লেখক: প্রতিবন্ধিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক পরামর্শক