বঙ্গবন্ধুর ছিল অসাধারণ সম্মোহনী ক্ষমতা
বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি কলেজে পড়ার সময় থেকেই উনার সঙ্গে পরিচিতিটা বাড়তে থাকে। সারাদেশেই সেটি বাড়ছিল। তখন থেকেই আমদের মাঝে একটি আকর্ষণ তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর কথা, উনার বক্তব্য সবকিছুর প্রতিই একটি প্রচণ্ড রকম আগ্রহ ছিল। উনার যেকোনো সভা থাকলে অথবা যদি জানতাম উনি কোথাও আসবেন আমরা সেখানে গিয়ে হাজির হতাম। ৭মার্চের ভাষণেও আমি ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ হয়েছিল খুব কাছে থেকেই। তখন থেকেই তাঁর প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছিল।
একটি সম্মোহনী ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ছিল। উনার চলাফেরা কথা বার্তা কাপড় চোপড় সবই ছিল আমাদের জন্য বিশেষ এক ভাললাগার বিষয়। উনি কোথাও উপস্থিত হয়েছেন জানতে পারলে সহজে বাদ দিতাম না। সবাই অংশগ্রহণ করতাম। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত ছিলাম। যখন থেকে উনি বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা তখন থেকে তাকে আসলে নিজের পিতা বলেই মনে হত।
সরকারি চাকরি করাকালীন সময়ে তখন আমি সমবায় সমিতি বিভাগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সেসময় মনে হত দেশটিকে নতুন করে গড়তে হবে। আমাদের কিছু দাবি দাওয়া যেগুলো ছিল, আমরা ভাবলাম সেটি নিয়ে বংগবন্ধুর সঙ্গে কথা বলা যায় কি না। দাবি দাওয়ার চেয়ে বেশি এক্সাইটেড ছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে কথা বলব। যাইহোক, উনার সঙ্গে কথা বলার সময় আমরা আড়ষ্ট ছিলাম। কিন্ত আমাদের বক্তব্যগুলো শুনে উনি যখন কথা বললেন, উপদেশ দিলেন, মনে হল আমাদের কথাগুলোই উনি বলে দিলেন। প্রথম দিনের আলোচনা শেষে বংগবন্ধুর কথামত আমরা কাজ শুরু করে দিলাম। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উনার কথা শুনতাম এবং তার উপদেশ মতো সেভাবেই আমরা কাজ করতাম।
একটি নেতার বৈশিষ্ট্য যেমন একজন মানুষকে অনুসরণ করার বিষয়টি সেটি উনাকে দেখে আমরা শিখতাম। এমন নেতৃত্ব আর আসবে না বলেই আমার মনে হয়।
আমরাতো প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করি। সেটি নিয়ে আমাদের বহুবার সুযোগ হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার। একবার ফরমাল মিটিংএ তিনি ইনফরমালভাবেই বললেন যে, আসাদ গেটের সামনে অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ ছিল। তারা এখন কোথায় এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তাদের কীভাবে চিনেন? কথা প্রসঙ্গে উনি আরও বললেন, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে আমি ওখানে যেতাম ওদের জন্য খাবার নিয়ে।বাবার ছায়া তার কন্যার মাঝেও দেখেছি।
১৫ আগস্টে ভোর রাতে গোলাগুলি শুনে আমরা সকলেই পথে বের হয়ে এসেছিলাম। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই সবাই বলাবলি করছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। একবার শুনি দুইজনকে মেরে ফেলেছে, একবার শুনি পাঁচজনকে মেরে ফেলছে, একবার শুনি শেখ কামালকে মেরে ফেলেছে, একবার শুনি বঙ্গমাতাকে মেরে ফেলেছে। সারাটা দিন গেল শুধু নিজের কাছে একটাই প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলল, আমরা কিছুই করতে পারলাম না! আমরা কেন কিছুই করতে পারলাম না! এটিরই কোনো উত্তর নেই আমাদের কাছে।কেউ এগিয়ে এল না। কেন এগিয়ে আসেনি তখন। এই কষ্টটুকু এখনো মনের মধ্যে লাগে। আমরাও তো পারতাম যেতে। আমরা কেন সেই উদ্যোগটুকু নিতে পারিনি।
৩০০ গজের ভেতরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কাছে যেতে পারছি না।সেই কষ্টটা এখনো বুকের মাঝে কাঁটা হয়ে বাজে ।তারপর তো সবই ইতিহাস। ৭৫ মানেই বাঙালি জাতিস্বত্তার জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক সবচেয়ে বেদনার সবচেয়ে কলঙ্কজনক ইতিহাস।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর ডিস্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি)