কামারশালা ও সৈয়দপুর
টুং-টাং আওয়াজে হাতুড়ি আর হ্যামার বর্ষণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। এক কথায় বলা যায় হাপর আর হাম্বলের প্রাচীন পেশা। কামার একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পেশা। দূর অতীতে কৃষিকাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গভূমিতে কামার পেশার উৎপত্তি ঘটে। হিন্দু সমাজের শূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে লোহার কারিগর তথা কর্মকার শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে।
প্রচলিত লোককাহিনী মতে, কোনো এক শূদ্র নারীর সঙ্গে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার প্রণয় থেকে কর্মকার বা কামারের জন্ম হয়। কামারদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা বসুন্দরী, রানা, গঙ্গালিরি ও বাহাল অথবা খোটা। এইচ.এইচ রিসলে-র মতে, পূর্ববাংলায় কামারদের তিনটি সামাজিক শ্রেণি হচ্ছে বুষ্ণপতি, ঢাকাই ও পশ্চিমা। বুষ্ণপতিরা আবার তিন ভাগে বিভক্ত, যথা নালদিপতি, চৌদ্দসমাজ ও পঞ্চসমাজ। বাংলাদেশের অধিকাংশ কামারই বৈষ্ণব কিন্তু অল্পসংখ্যক কামার শাক্ত ধর্মাবলম্বী। আবার জীবিকার তাগিদে অনেক মুসলমান পরিবারও এ পেশায় জড়িয়ে আছেন।
প্রস্তর যুগের পর দূর অতীতে এ শিল্প ছিল রাজাদের নিয়ন্ত্রণে। কামারশালায় রাজ্য ও রাজপ্রাসাদ রক্ষায় অস্ত্র বানানো হতো। অনগ্রসর নৃগোষ্ঠীরাই ছিল কর্মী। ১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরে কামারশিল্প সম্প্রসারিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মিসর সম্রাজ্ঞী সর্বশেষ সপ্তম ক্লিওপেট্রা ও রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার কামারশালাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান। বিশ্ব সভ্যতার আগমনে কামার শিল্প থেকেই উত্তরণ ঘটে ফাউন্ড্রি ও লোহার ভারী শিল্পের। তারপর যন্ত্রযুগে পৃথিবীর এগিয়ে চলা। আজও হাটের বড় বৈশিষ্ট্য এই কামারশালা। কামারের কর্মস্থল ছোট্ট একটি ঘর। বেশিরভাগই উন্মুক্ত। কোনোটির উপরে টিনের চালা। চারদিকে ফাঁকা। কোনোটির উপরে চালাও নেই। প্রধান উপকরণ হাপর। শক্ত চামড়া গোলাকৃতি ত্রিকোণা করে নির্দিষ্ট মাপে কয়েকটি ভাঁজে তৈরি। এই হাপর মাটির ওপর দৃশ্যমান। হাপরের নিচে পাইপ বসিয়ে তা মাটির ভেতরে রেখে টেনে নেওয়া হয় ৪/৫ ফুট দূরে। হাপরের দুই ধারে বাঁশের সঙ্গে যুক্ত লম্বা ছোট বাঁশ; যা সামনের দিকে টেনে নেওয়া হয়। সেখানে লিভারের মতো উপর-নিচ টানার ব্যবস্থা থাকে।
তারপর লিভার টেনে হাপরের বাতাস পাইপ দিয়ে পৌঁছানো হয় মাটির ওপর স্থাপিত ছোট্ট চুল্লিতে। এই চুল্লিতে থাকে কাঠকয়লা। তাতে আগুন ধরিয়ে লিভার টেনে হাপরের বাতাসে তাপ নিয়ন্ত্রণ ও উস্কে রাখা হয়। এই চুল্লিতে লোহা রেখে তাপ দেওয়া হয়। আগুনে তাপিয়ে লোহা আগুনের রঙে হলে বড় হাম্বল দিয়ে পিটিয়ে নানা আকৃতির জিনিস বানানো হয়। আগুনে লোহা পেটানোর জন্য কামারের সহযোগী থাকে এক বা দুজন। তাপে লোহা পেটানোর উপযোগী হওয়ার সঙ্গেই হাম্বল দিয়ে দ্রুত পেটাতে হয়। তাপ কমে গেলে মাপ মতো বাঁকানো যায় না। যে পণ্য বা জিনিস বানানো হবে পেটানোর পর তার টেম্পার (শক্তিমান) বেশি রাখতে পানির ভেতর ধীরগতিতে প্রবেশ করিয়ে হালকাভাবে শীতল করতে হয়। তারপর ফিনিশিং।
অতি প্রাচীন এই কামার শিল্পের কদর এখনও হারিয়ে যায়নি। যদিও লেদ মেশিনে এখন অনেক কিছুই তৈরি হচ্ছে। তারপরও লৌহজাত দ্রব্যাদি কামাররাই তৈরি করেন। তবে কালের বির্বতনে কামাররাও স্মার্ট হয়েছেন। অর্থাৎ কামারশালের টুং-টাং আওয়াজের সঙ্গে বেশিরভাগ কামারপট্টিতে হাপরের জায়গায় যুক্ত হয়েছে মোটর দিয়ে তৈরি করা একটি বিশেষ মেশিন। কামাররা এর নাম দিয়েছেন ‘বুলার’। একটি মোটা পাইপের মধ্যে দিয়ে বিরামহীনভাবে বাতাস ঢুকছে কয়লার অগ্নিকুণ্ডে। আর সেখানে পুড়িয়ে লাল করা হচ্ছে মোটা মোটা লোহার পাত। সেখান থেকে টিনের চিমনি বেয়ে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে। লোহা পুড়ে লাল হতেই সাঁড়াশি দিয়ে ধরে তোলা হচ্ছে রেললাইনের কাটা খণ্ডের ওপর। এর পরপরই শুরু হচ্ছে হাতুড়ি আর হ্যামারের বর্ষণ। চোখের পলক ফেলতেই লোহার পাতটি ধারালো চাপাতি হয়ে যাচ্ছে। হাতুড়ির বাড়ি আর হাতের জাদুতে আগুনে পোড়া লালাভ কাঁচা লৌহখণ্ড ছুরি-চাকু, বটি, কৃষকের কাস্তে, নিড়ানি, খন্তি, কোদাল, লাঙলের ফলা, শ্রমিকের কুঠার, শাবল, দা, বড় চাকু (দা, বড় চাকু, ছোরা বেশি ব্যবহার করে মাংস ব্যবসায়ী কসাই) করাত, বাইশ, বাটালি, রামদা, হাতুড়ি, পাট কাটার বেকি, পাসুন, পান কাটার সর্ত্তাসহ গৃহস্থালি কাজের বিভিন্ন আকার দিয়ে ধারালো সামগ্রী তৈরি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন।
ভারী হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটানো খুবই কষ্টকর। তা ছাড়া কয়লার আগুনের পাশে ও কয়লার ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগেও ভূগছেন কামাররা। নানা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে দেশে কামার সম্প্রদায় আগের মতো নেই। শুধু ঈদ ও পূজাপার্বণ এলেই এ কাজে কদর বাড়ে তাদের। অর্থাৎ তারা কাঁচামাল সুলভ মূল্যে না পাওয়ায় অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। আবার অনেকে বলছেন- ‘বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি তৈরি করার ফলে তাদের হাতের তৈরি সরঞ্জামাদির প্রতি মানুষের আগ্রহ দিনদিন কমে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের এই পেশায় তাই তারা আনেননি। কারণ বর্তমানে লোহা কয়লার দাম বেড়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের হাতে তৈরি সরঞ্জামাদির দাম বাড়েনি। অবার অনেকে বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখার কারণে মানবেতার জীবনযাপন করছেন। তা সত্বেও গ্রামীণ মেলায় লোকজ পণ্য হিসেবে কামারদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীই আজও শোভা বর্ধণ করে।
আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় নিত্য নতুন জিনিসপত্রের দাপটে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কামারশিল্প। যুগের পরিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় একটু একটু করে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে হাতে তৈরি লোহার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। নতুন করে স্থান করে নিচ্ছে চায়না ও ভারত থেকে আসা অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের যন্ত্রপাতি। দাম বেশি হলেও টেকসই হওয়াতে ক্রেতারা কিনছেন স্টিলের চাকু, খুন্তি, কাস্তেসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ফলে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের যন্ত্রপাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কামারশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এখন এ পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছেন। মাথায় হাত পড়েছে বাংলার কামারদের। প্রয়োজনীয় জ্বালানি কয়লা ও লোহাজাত শিল্পে আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন হওয়ায় কামারদের সুদিন আর নেই। প্রয়োজনীয় পূঁজি না থাকায় ও উপকরণ সমূহ সঠিক ভাবে না পাওয়ায় তাদের এ দুরবস্থার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন স্থানীয় সুধী মহল।
সুধীমহল আরও মনে করছেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কামারশিল্প নতুন যৌবন ফিরে পাবে। সে কারণেই কামার শিল্প দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তবুও যন্ত্র যুগে প্রাচীন এ শিল্প কামারশালা বা কামারের বাড়ি সৈয়দপুরে আজও চোখে পড়ে। উপজেলার হাজার হাজার কামার শিল্পী তাদের নিখুঁত হাতের কারুকাজের মাধ্যমে বর্তমান আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থার মাঝে টিকে রয়েছে অতি কষ্টে।
ঘনবসতি ট্রানজিট সিটি সৈয়দপুর উপজেলায় পাঁচটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, পেশা পরিবর্তন করলেও বেশিরভাগ কামাররা পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রেখেছেন। চার পুরুষ থেকে এ কাজ করছেন এক মুসলিম পরিবার। গর্বের সঙ্গে বলেন, বর্তমানে তাদের সন্তানরাও এ পেশায় নিযুক্ত আছেন। এ পেশায় তাদের আগের মতো আয় না থাকলেও পৈত্রিক পেশা বংশ পরমপরায় তারা এ পেশাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। কখনও ছাড়বেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এসব কামার সভ্যতাকে মেনে নিয়ে নিজেরাও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কামারপল্লির দোকানে বিদ্যুৎচালিত শান মেশিন ব্যবহার করে অল্প সময়ে অধিক কাজ করছেন। আধুনিক ব্যবসা সেবা যখন মানুষের দোড়গড়ায় তখন লোহা পেটানোর পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় মৌসুমভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ কামাররাও শান দেওয়ার যন্ত্র (পা চালিত) ঘাড়ে নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় দা, বঁটি, ছুরি, চাপাতি ও অন্য সরঞ্জাম শান দিচ্ছেন।
বর্তমানে চাপাতি বা চাপ্পর সাড়ে ৩০০ টাকা কেজি, ছুরি ৪০০ টাকা কেজি এবং বটি সাড়ে ৩০০ টাকা কেজি হিসাবে বিক্রি করছেন তারা। চাহিদা থাকায় ক্রেতাদের জন্য নিত্যনতুন হাতিয়ার তৈরি করছেন। আর আকার ভেদে ১০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যেও কোরবানির জন্য বিভিন্ন হাতিয়ার তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বড় ছুরি ৪০, চাপাতি ৬০, দা ৫০ ও ছোট ছুরি ২০ টাকায় শান দিচ্ছেন তারা। তা ছাড়া একটি দা আকার ও লোহা ভেদে ২০০ থেকে-৫০০ টাকা, ছুরি আকার ভেদে ৫০ থেকে ৪০০ টাকা, হাড় কাটার চাপাতি একেকটি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং পুরোনো যন্ত্রপাতি মেরামত করতে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন এখানকার কামাররা। এসব কিনতে আশ-পাশের ১২টি উপজেলা থেকে ক্রেতারা আসেন।
সৈয়দপুরে এর চিত্র কিছুটা ভিন্ন দেখা দেওয়ার পেছনে বড় একটি কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীন শহরের মধ্যে অন্যতম শহর সৈয়দপুর। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য সৈয়দপুর শতাব্দীজুড়ে খ্যাত হলেও অনেকের কাছে রেলওয়ে শহর বলে পরিচিত। তথাপিও দেশের অস্টম বাণিজ্য শহর সৈয়দপুর। বাংলাদেশের বৃহত্তরও রেলওয়ে কারখানা রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলার অন্তর্গত সৈয়দপুর উপজেলায়। ১৫১ বছর আগে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ১১০ একর জমির ওপর বৃটিশ শাসন আমলে নির্মিত ২৬টি শপে শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন। নানা ধরনের নাট-বল্টু ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করা শুরু থেকে রেলওয়ের ব্রডগেজ এবং মিটারগেজ লাইনের কোচ মেরামতসহ সবধরনের যন্ত্রপাতির কাজ করা হয় এখানে। এ ২৬টি শপের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি কামারশালা শপও রয়েছে এ কারখানায়।
অতীতে এ কামারশালায় টুং-টাং আওয়াজে হাতুড়ি আর হ্যামার বর্ষণের বিশাল কর্মযজ্ঞ ছিল। কিন্তু এখন আধুনিক অর্থাৎ ইলেকট্রিক হামার মেশিনে এসব যন্ত্রাদি তৈরি হচ্ছে। তারপরেও কিছু কিছু প্রচীন পদ্ধতি এখনও চোখে পড়ে। এ কারখানাকে ঘিরে এ উপজেলায় শত শত লোহা লক্কর আর ভাঙড়ির গোডাউন গড়ে উঠেছে।
অন্য শহরে কামাররা লোহা পেতে অনেক বেগ পেতে হয় এমনকি কয়লা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু এ অঞ্চলে কামাররা কয়লা খুব সহজে পেয়ে যান এমনকি লোহাও। তাই কামারদের অনেকটাই ঠাঁই হয়েছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাকে ঘিরে। প্রত্যাশা ব্যক্ত করি, তাদের যাপিত জীবনে নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকুক কয়লা আর স্বল্প মূল্যে লোহা। কামাররা এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি।
এসএন