গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কি নিয়মিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে?
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছুটাছুটি, টেনশন, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেওয়ার নিমিত্তে বহু লেখালেখি ও আলোচনা চলছে বহুদিন যাবত। কিন্তু বিষয়টিতে পুরোপুরি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজি করানো যায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিও জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী ২০১৯ সালে গুচছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে দেশের ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতিতে অংশ নিয়েছে। এবার ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে নতুন যুক্ত হয়েছে কিশোরগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ মোট ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনার জন্য গুচ্ছভুক্ত হয়েছে। তার মানে হচ্ছে এখনো অর্ধেকের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু এই পদ্ধতির আওতাভুক্ত হয়নি। ৩০ জুলাই ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পদ্ধতিতের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলেছে, সারাদেশের ১৯টি কেন্দ্রের ৫৭টি উপকেন্দ্রে । ঐদিন ’ক’ ইউনিটে বিজ্ঞান বিভাগের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৩ আগস্ট ’বি’ ইউনিটে মানবিক এবং ২০ আগস্ট ’সি’ ইউনিটে বাণিজ্য অনুষদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ইউনিটে পরীক্ষার জন্য মোট আবেদন পড়েছে দুই লাখ ৯৪ হাজার ৫২৪টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ক’ ইউনিটে, প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার। গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকােনো একটিকে কেন্দ্র হিসেবে পছন্দ করার সুযোগ ছিল আবেদনকারীদের, যার মধ্যে ঢাকায় কেন্দ্র পছন্দ করেছে প্রায় ৬৫ হাজার ভর্তিচ্ছু অর্থাৎ ৪০ শতাংশ। ভর্তিচ্ছুদের রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, বাংলা ও ইংরেজি থেকে যেকোনো চারটি বিষয়ে মোট ১০০ নম্বরের উত্তর দিতে হয়েছে ৩০ জুলাইয়ের পরীক্ষার ফল ৩ আগস্ট হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আভাস দিয়েছে।
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় সুষ্ঠুভাবে অংশগ্রহণে শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল বেশকিছু নির্দেশনা। যেমন-অনলাইনে প্রদত্ত প্রবেশপত্র অফসেট কাগজে রঙিন প্রিন্ট করে এবং উচচমাধ্যমিকের মূল রেজিস্ট্রেশন কার্ড অবশ্যই পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে আসা, যেখানে পরীক্ষার্থীর রঙিন ছবি এবং তথ্য স্পষ্টভাবে মুদ্রিত থাকতে হবে। পরীক্ষা শুরুর এক ঘন্টা আগেই পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে উপস্থিত হতে হবে। কেউ চাইলে তার আগেও কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে। নির্ধারিত রুম খোলা হবে পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি পরিক্ষার্থীকে অবশ্যই তার নির্দিষ্ট আসনে বসে পরীক্ষা দিতে হবে। তবে পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর কোনো পরীক্ষার্থী হলে প্রবেশ করতে পারবেন না। পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র, অ্যাটেনডেন্স শিট ও ওএমআর শিটে অভিন্ন স্বাক্ষর থাকতে হবে। উত্তরপত্রে কালো কালির বল পয়েন্ট কলম ব্যবহার করতে হবে। সেখানে পেন্সিল ও ক্যালকুলেটরসহ যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার সম্পূর্ন নিষিদ্ধ ছিল।
গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না, বরং একটি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি লাঘব করবে। প্রশ্নপত্রে বাংলা, ইংরেজি, রসায়ন, গণিত ঠিকই থাকছে। তারপরেও একটি পদ্ধতি শুরু হলে প্রথমে তার অনেক সমস্যা থাকে। সে ধরনের কিছু সমস্যা তো বৃহত্তর স্বার্থে মোকাবিলা করতেই হবে। গতবছর শিক্ষার্থী পাওয়া নিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা ছিল। কয়েকবার অপেক্ষমান তালিকা থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। তার অন্যতম কারণ ছিল বিলম্বে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া। গতবার শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারেনি, যেটি এবার সংশোধন করা হয়েছে। এতগুলো বিশ্ব বিদ্যালয়ে একটি জায়গা থেকে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র নিজেদের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যাওয়া এবং পরীক্ষা শেষে আবার উত্তরপত্র এনে এক জায়গায় জড়ো করা পরীক্ষা কমিটির জন্য একটি কঠিন কাজ।
এককভাবে পরীক্ষা নিলে শিক্ষকদের অর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই বিষয়টিতে সেক্রিফাইস করা হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীরা যাতে সহজে নিজ পছন্দের বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে সেজন্য এমন একটি পদ্ধতি বের করা প্রয়োজন, যাতে তারা একটি কিংবা বড়জোর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েই পছন্দমতো বিষয়ে ভর্তি হতে পারে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা গুচছ পরীক্ষা নিচ্ছে। বুয়েট বাদে প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একত্রে পরীক্ষা নিচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে যে, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আগামী দুই বা তিন বছরের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে। আমাদের যদি বড় মাপের ৮-১০টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকতো তাহলে গুচ্ছ পরীক্ষা প্রয়োজন হতো না। এখন যেহেতু ৫০টির কাছাকাটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, অতএব গুচ্ছ পরীক্ষা নিতেই হবে কারণ ভর্তিচ্ছুদের পক্ষে জেলায় জেলায় ঘুরে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়, ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও আলাদা আলাদা পরীক্ষা আয়োজন করা রাষ্ট্রীয়ভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী নয়।
একটি বিষয় এবারকার গুচ্ছ পরীক্ষায় বড় প্রশ্ন আকারে দেখা দিয়েছে। সেটি হচ্ছে ঢাকায় ৪০ শতাংশ ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থী কেন? তারা যাতে নিজ জেলা বা পার্শ্ববর্তী জেলায় বসে পরীক্ষা দিতে পারেন সেজন্য এই ব্যবস্থা, অথচ ঢাকায় বিশাল অংশের পরীক্ষার্থী কেন? কেউ কেউ বলছেন, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ঢাকার মানসম্পন্ন কলেজে অনেকেই ভর্তি হয়, তারা ঢাকায় কেন্দ্র দিয়েছে এবং সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভুক্ত না হওয়ায় তারা ঢাকা থেকে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজে যেতে পারবে। যেমন জাহাঙ্গীরনগর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকায় আসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকে। আবার কেউ নিজেদের মতো করে বাসা ঠিক করে।
আর একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে যে, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি অথচ ২০২১-২০২২শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল কাঠামোও চূড়ান্ত করা হয়নি। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের পর আগে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে একটি ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হতো। এরপর শুরু করা হতো শিক্ষার্থী ভর্তিসহ অন্য সব শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু কয়েক বছর যাবত দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনুমোদনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অনুমোদন পাওয়ার পর কোনো ধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও শিক্ষক নিয়োগের আগেই চলছে শিক্ষর্থী ভর্তি। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমও চলছে অগোছালোভাবে।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব অবকাঠামোয় ক্লাস শুরুর আগেই কয়েকটি ব্যাচ গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে বের হয়েছে। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০০২ সালে আইন পাস হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫সালে। রাঙামাটি শহরের একটি বেসরকারি স্কুলের অবকাঠামো ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় অনেকটা অগোছালোভাবেই। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিজেদের ক্যাম্পাসে কার্যক্রম স্থানান্তর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগেই কয়েকটি ব্যাচ গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে ফেলেছে। যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত না করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি গুনগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রতিবন্ধক। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একাডেমকি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কয়েকটি ভবন নির্মান করা হলেও এখনো শিক্ষার্থীদের জন্য কোন ধরনের আবাসিক ভবন নির্মান করা হয়নি। একেবারে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা কতটা যৌক্তিক সেই প্রশ্ন যেমন থেকে যাচ্ছে, তেমনি এসব বিশ্ববিদ্যালয় তো এককভাবে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনই করতে পারত না লোকবলের অভাবে।
৩০ জুলাই পরীক্ষায় আরও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। তাই গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও একই সিলেবাসে নেওয়ার কথা ছিল কিন্তু বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ’ক’ ইউনিটের পরীক্ষায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের বাইরে থেকেও প্রশ্ন এসেছে বলে পরীক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে। প্রশ্ন প্রণেতারা সংক্ষিপ্ত সিলেবাস সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কি না সেটি দেখার বিষয়। আগামী ১৩ আগস্ট ও ২০ আগস্টের পরীক্ষায় যাতে এটি না ঘটে সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হলেও মূল্যায়ন একভাবে করা যায়, পুরো বই থেকে প্রশ্ন করার যেহেতু কথা ছিল না সেটি খতিয়ে দেখা দরকার এবং এ জন্য শিক্ষার্থীদের পেনালাইজ করা যাবে না। তারা কিন্তু ইতিমধ্যে পরীক্ষার হলে বিপাকে পড়েছে। পরীক্ষা কমিটি জানিয়েছে বিষয়টি তাদের লিখিতভাবে জানাতে ।
লেখক: কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ (ভাব) এবং প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব), মোবাইল:০১৭১৪-০৯১৪৩১ ইমেইল: masumbillah65@gmail.com