বড় বাজেটের সুফল কার ঘরে ?
বাজেট হলো সাংবিধানিক ভাষায় রাষ্ট্রের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী। এর একটা অর্থনৈতিক দিক এবং একটা দর্শনমূলক দিক থাকে। বাজেটের আয়তন প্রকাশিত হয় টাকার অংকে। টাকা দেবে কারা আর বরাদ্দ কোথায় পাবে, কারা পাবে তা দ্বারা বুঝা যায় যারা ক্ষমতায় থেকে বাজেট প্রণয়ন করছেন তারা কোন রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন। প্রতি বছরই বাজেট বড় হচ্ছে। এই বড় হওয়া অর্থনীতির বড় হওয়াকেই নির্দেশ করে। অর্থনীতিকে বড় করার পিছনে ভুমিকা যাদের তাদের ভাগে বাজেটে কি থাকবে বা কতটুকু থাকবে তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক চিন্তা দ্বারা।
২০২২- ২৩ অর্থ বছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজস্ব ব্যয় ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। ব্যয়ের হিসাব তো দেখা গেল কিন্তু আয় আসবে কোথা থেকে? বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর যে কর আদায় করবে তার পরিমাণ ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে আয় হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং করব্যতিত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে আয় ব্যয়ের ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটানো হবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে, সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় ঋণ করে আর অনুদান নিয়ে। ঋণ ও সুদ পরিশোধে বাজেটে বরাদ্দ ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। ঋণ করে কে আর ঘি খায় কে সেই প্রশ্ন তো করা যেতেই পারে।
ঘাটতির মধ্যে অনুদানসহ বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা; আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, এর মধ্যে আবার ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।
স্বাধীনতার পর ৫১ তম বাজেট এটা। প্রতিবছরই বাজেট বড় হচ্ছে। ১৯৭২ সালের প্রথম বাজেটের তুলনায় ৮৬০ গুণ বড় এই বাজেট।
মহা আড়ম্বরের বৃহৎ বাজেটের বোঝা জনগণের উপর চাপিয়ে সরকার কৃতিত্ব নিতে চাইছে। বাস্তবে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার এই বাজেট আয়তনে বড় কিন্তু তাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর কৃষির জন্য আনুপাতিক হারে বরাদ্দ বাড়েনি। যেমন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাখাতে টাকার অংকে মোট বরাদ্দ বেড়েছে। এই দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য নতুন অর্থ বছরে মোট ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকাবরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। ফলে শিক্ষায় গত বাজেটের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল এবার তা ১২ দশমিক ০১ শতাংশ হয়েছে। করোনায় বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত ও শিক্ষার্থীদের জন্য বাজেটে কোন নির্দেশনা নেই। যে বিপুল শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তাদেরকে শিক্ষার মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ কি? বিভিন্ন রিপোর্ট বলছে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আর কখনোই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারবে না তাদের মত শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা কি চিরদিনের জন্য বন্ধ থাকবে?
এমনি অবস্থা স্বাস্থ্যখাতেও। দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্থ স্বাস্থ্যখাত গুরুত্ব পায়নি। স্বাস্থ্যে বরাদ্দ এত আলোচনা সমালোচনার পরও ৫ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি হয়নি, স্বাস্থ্য গবেষণায় মাত্র ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। করোনাকালে দেশকে টিকিয়ে রাখার স্বীকৃতি দিলেও বাজেট বরাদ্দে কৃষিও গুরুত্ব পায়নি। ২০১২–১৩ সালে কৃষিতে ১০ শতাংশ বরাদ্দ ছিল ১০ বছর পর তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কোন নতুন নির্দেশন নেই। সাধারণ মানুষের কর যোগ্য আয় সীমা বাড়েনি বরং বৃহৎ পুঁজিপতিদের করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমেছে। এসি রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ শতাংশ কমিয়ে এসি, নন এসি রেস্তোরাঁর ট্যাক্স সমান করা হয়েছে। সাধারণত দরিদ্র নিম্নবিত্ত মানুষেরাই নন এসি রেস্টুরেন্টে খেয়ে থাকেন।
সবচেয়ে বড় কথা এই বাজেটে টাকা পাচারকে স্বীকার করে নিয়ে তাঁকে আইনি বৈধতা দেয়া হয়েছে। কেউ ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে পারবে, বিদেশে অবস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি দেশে না আনলে ১০ শতাংশ আর স্থাবর সম্পত্তি দেশে না আনলে ১৫ শতাংশ কর দিলে যদি বৈধতা পায় তাহলে টাকা পাচার তো কমবেই না বরং উৎসাহিত হবে।
কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দেয়ার পরও সংবিধানের সাথে চূড়ান্ত অসঙ্গতিপূর্ণভাবে কালো টাকা সাদা করা চলছেই। এবারেও ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। ২৫ শতাংশ কর এবং করের উপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে অর্থাৎ ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। জমি ও ফ্লাট কিনে এলাকা ভেদে ও আয়তন ভেদে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে এবারের বাজেটেও যা কোনভাবেই যুক্তিসংগত নয়।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)