ই-বর্জ্য মারাত্মক হুমকি
ই-বর্জ্য সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। আবার যাদের ধারণা আছে তাদের অনেকেই বিষয়টিকে খুব সহজভাবে নিচ্ছেন। এটি যে পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্য মারাত্মক হুমকি তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। জানা নেই এর প্রভাবে যে মানুষের মৃত্যুও ঘটতে পারে সেই তথ্যও। ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানার আগে আমরা জেনে নেই এটি আসলে কী ধরনের বর্জ্য।
ই-বর্জ্য হচ্ছে, ইলেকট্রনিক বর্জ্য। যেমন–পরিত্যক্ত টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, এয়ারকন্ডিশনার, মাইক্রোওভেন, সিএফএল বাল্ব, ওয়াশিং মেশিন, মুঠোফোন, ডিভিডি প্লেয়ার, ইলেকট্রনিক খেলনাসামগ্রী ইত্যাদি। এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যবহারের পরে যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখনই এটি বর্জ্যে পরিণত হয়, যা ই-বর্জ্য নামে পরিচিত। সাধারণ দৃষ্টিতে এগুলোকে চিরাচরিত বর্জ্য মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়।
ই-বর্জ্যের রয়েছে মারাত্মক রেডিয়েশন, যা বিভিন্নভাবে পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে আমাদের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে নানা ধরনের উপাদান থাকে। যেমন–ক্যাডমিয়াম, লিড অক্সাইড, সিসা, কার্বন, সিলিকন, বেরিলিয়াম, ফাইবার গ্লাস, পারদসহ নানা ধাতব উপাদান। ইলেকট্রনিক সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেলেও উপাদানগুলো নিঃশ্বেষ হয় না, বর্জ্যের মধ্যেই থেকে যায়। এগুলো পচনশীল নয় বিধায় পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে। ফলে মাটি, গাছপালা, ফসল ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যে প্রভাবের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনও ঘটতে থাকে ধীরে ধীরে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুরনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী যখন ভাঙাড়ির দোকানে স্থান পায়, তখন দোকানির প্রয়োজনে এ বর্জ্যগুলোকে রোদের তাপে শুকিয়ে নেয়। অথবা অনেকে বর্জ্যগুলোকে দোকানে না রেখে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। বিপদ তখনই ঘটতে থাকে। রোদের তাপে ‘ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট’ যেটি আমাদের কাছে ‘আইসি’ নামে পরিচিত, তা থেকে মারাত্মক বিকিরণ নির্গত হতে থাকে। শুধু রোদেই নয়, এটি মাটির নিচে চাপা দিলে কিংবা পানিতে ফেলে দিলেও ক্ষতিকর বিকিরণ নির্গত হতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, এক চা চামচ পরিমাণ পারদ ২০ একরের একটি জলাশয়ের পানি আজীবনের জন্য ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলতে পারে। আর যত্রতত্র ফেলে রাখার কারণে ই-বর্জ্যের রেডিয়েশন রিসাইকেলের মাধ্যমে মানবদেহে দ্রুত প্রবেশ করে। পরবর্তীতে মানুষের ত্বক, কিডনি, ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, যকৃত, মায়েদের স্তন ও মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি করে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় জানা যায়, দেশে বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে জাহাজ ভাঙা থেকে ৮০ শতাংশ বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে, বাকি ২০ শতাংশ দেশে উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মুঠোফোন সেট থেকে বেশি ই-বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। আমাদের দেশে ই-বর্জ্যের রিসাইক্লিং ব্যবস্থা না থাকাতে এসব বিষ ফোঁড়ায় পরিণত হচ্ছে। আবার উন্নত বিশ্বে রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও লোকজন কৌশলে দরিদ্র দেশে ই-বর্জ্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাদের ইলেকট্রনিক পণ্যসামগ্রী একটু নষ্ট হলে কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সেটি মেরামত না করেই বাড়ির সামনের ডাস্টবিনে ফেলে রাখে। আর সেগুলো দরিদ্র দেশের লোকেরা কুড়িয়ে সামান্য মেরামত করে নিজ দেশে পাঠিয়ে দেন। অনেক সময় মেরামতেরও প্রয়োজন পড়ে না। যারা এমনটি করছেন, ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছেন না দেশের মানুষের কী ক্ষতিটা করছেন তারা।
শুধু কুড়িয়ে পাঠানোই নয়, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে রিকন্ডিশন গাড়ি, কম্পিউটার কিংবা অন্যান্য ইলেট্রনিক সামগ্রীর খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করা হচ্ছে, যার অধিকাংশই থাকে মেয়াদোত্তীর্ণ। অথচ সেসব পণ্যসামগ্রী আমাদের দেশে দিব্যি ব্যবহৃত হচ্ছে। যার প্রভাবে ধীরে ধীরে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে, জলবায়ুরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে; যা আমরা তাৎক্ষণিক টের পাচ্ছি না, দেখছি না খালি চোখে, পারছি না সহজেই উপলব্ধি করতেও। অর্থাৎ অনেকটাই মোবাইল ফোন টাওয়ার থেকে নির্গত অদৃশ্য দূষণের মতো। ক্ষতি হচ্ছে; কিন্তু কারণ নিরূপণ করা যাচ্ছে না। সোজা কথা, ই-বর্জ্যের রেডিয়েশনে আমরা মারাত্মক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও সেটি চাপা থেকে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে চিকিৎসকরাও আমাদের সতর্ক করতে পারছেন না। কারণ বিষয়টি তিনি নিশ্চিত নন, রোগ শনাক্ত করতে সক্ষম হলেও রোগের উৎপত্তি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে ওই রোগী কিছুটা সুস্থ হলেও পরিবেশ বিনষ্ট ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ হচ্ছে না; পাশাপাশি আবার নতুন করে অন্যজনও রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই মনে করছেন অনেকেই।
বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে দ্রুত। ই-বর্জ্যের রেডিয়েশন-দূষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের খুব দ্রুত রিসাইক্লিং কারখানা গড়ে তুলতে হবে। যে কারখানায় ই-বর্জ্য প্রসেস করে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী যন্ত্রাংশ তৈরি করা যাবে।
উল্লেখ্য, দেশে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানা হাতেগোনা কয়টি মাত্র, যা আমাদের ই-বর্জ্যের চেয়ে সংখ্যায় অপ্রতুল। অথচ ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানা হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় শিল্পও। শিল্পটির বিস্তার ঘটলে দেশে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে যেমন, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট রোধ হবে। রোধ হবে জলবায়ুর পরিবর্তনও। আমরা তাই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ই-বর্জ্যের মজুত ও প্রসেসিং নীতিমালা তৈরির জন্য।
কামনা করছি, ই-বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য অন্তত প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ঝুঁকিমুক্ত ডামপিং স্টেশন নির্মাণের। যা নির্মাণে ইলেকট্রিক এবং ইলেকট্রনিক (উৎপাদিত) কোম্পানিকে অর্থ প্রদানের জন্য সরকার বাধ্য করবেন। পাশাপাশি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি পরিবেশ অধিদপ্তর ‘ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা-২০১৮’ শিরোনামে পুরনো বা ব্যবহৃত পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য। তাতে করে জলবায়ু সংকট প্রতিরোধ হবে, পরিবেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে, অদৃশ্য দূষণ থেকে রক্ষা পাবেন সর্বসাধারণ।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
এসএ/