কিশোরীদের দেখা একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতি
মধুবন্তী ডায়েসের গল্প
[৩] একদিন বিকেলে, আমরা প্রায় ২০/২৫ জন ছেলেমেয়ে খেলা করছি একটা মাঠে। সেই মাঠটা বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। আমরা খেলা করে দল বেঁধে বাড়ি ফিরছি, সন্ধ্যাতো নেমে এসেছে। একটু একটু অন্ধকারও, এমন সময় দেখি দুইজন মিলিটারি আমাদের সামনে দাঁড়ানো। কখন কোন দিক দিয়ে যে এসেছে তা আমরা কেউ দেখিনি। আমরা তো দেখে ভয়ে পিছনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছি। তখন তারা পিছন থেকে আমাদেরকে ডাকছে। আমাদের মাঝ থেকে দুই তিনজন ছেলে দাঁড়িয়েছে। আর আমরা সবাই যার যার বাড়িতে চলে যাই । পরে শুনেছি, এমনি কথাবার্তা বলেছে। তোমাদের নাম কি, কি কর। আমরা তো বাড়ি এসে বলেছি মিলিটারিদের কথা। এখন দাদা আমাদেরকে মানে আমি পারুল, নার্গিস, রেনুকা, কম বয়সি যারা তাদেরকে ডেকে বলেছে, পাকিস্তানি মিলিটারিরা শুধু যুদ্ধই করে না, তারা সব লুটপাট করেও নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে যখন যেখানে যাকে পাচ্ছে তাদেরকে বিনা কারণে গুলি করে হত্যা করছে। আর মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের ইজ্জত নিচ্ছে। তোমরা বড় হয়েছ, তোমাদের যার যার মান ইজ্জত রক্ষা করার দায়িত্ব তোমাদের। মনে রাখবে নারীর মান ইজ্জত এমন একটা জিনিস, যা একবার চলে গেলে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। ইজ্জত হারা নারী পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল। নারীর একটা বড় সম্বল তা হল মান ইজ্জত। এসব কথা বলেছেন অনেকক্ষণ যাবৎ।
ঐদিনের পর ১০/১২ দিন আর কেউ কোথাও মিলিটারি দেখেনি। তার মানে ঐ দিনই তারা গ্রামে প্রথম এসেছিল এবং ঘুরে ঘুরে দেখেছে যে, কোথায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করা যায়, তারা তো তাদের সুবিধাজনক জায়গা বেছে বেছে থাকার ব্যবস্থা করেছে। কয়েকদিন পর এক বিকেলে দাদা আবার আমাদেরকে ডেকে নিয়ে সাবধান করে দিয়েছে। আমরাও সেইভাবে সাবধানে থাকার চেস্টা করছি। এরই মধ্যে একদিন খুব ভোরে দেখি মানুষের ডাকা ডাকি, অনেক মানুষের কথাবার্তা হচ্ছে। আমরা ঘর থেকে জানালা দিয়ে বাহিরে দেখার চেস্টা করছি। কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তখন আমরা ঘর থেকে বাহির হলাম, দেখি বাড়ির পিছনে অনেক লোক। সেখানে আমাদের বাড়ির সব পুরুষ, কিছু বলাবলি করছে। কিন্তু কোন কথাই বুঝতে পারছি না। এত লোক এক সঙ্গে কথা বললে কিছু বুঝা যায়? কৌতুহল থেকে আস্তে আস্তে আগাতে আগাতে এক সময় সেইখানে চলেই গেলাম। দেখি ঐখানে দুইজন মহিলার লাশ পড়ে আছে। তাদের শরীরে কোন কাপড় ছিল না। এখানে কেউ হয়ত তাদের উপরে কাপড় দিয়েছে। তাদের চোখ হাত বাঁধা। সারা শরীর আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। এক নজর দেখে পরে আর দেখতে পারিনি। ভয়ে লজ্জায় খুব দ্রুত চলে আসি ওখান থেকে। পরে বুঝতে পারি এ বিষয় নিয়ে কথা বলছে লোকজন। সেই লাশ দেখে ভেতরটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছে যেমন, ভয় করছে কি যেন জিজ্ঞাসা করবে। সেই দিনের পর থেকে হাসি-আনন্দ, ভাল লাগা সব হারিয়ে গিয়েছে। শুধু আমার না আমাদের বাড়ির, গ্রামের সবারই। বুঝতে পারলাম, আমাদেরকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।
আমার দাদার বাড়ি এমন একটা জায়গায়, জোয়ারের সময়, জোয়ারের পানি বাড়ির একেবারে খুব কাছাকাছি চলে আসে। বাড়ির দুই পাশ-দক্ষিণ আর পশ্চিম পাশ পানিতে ভরে থাকে। একদিন বিকেল প্রায় চারটা বাজে, এমন সময় আমি হাঁটতে হাঁটতে পানির কাছে যাই এবং পানিতে নেমে এমনিতেই হাঁটছি। ছোট ছোট ঢেউ পায়ে আছড়ে পড়ছে, ভাল লাগছে। ঢেউগুলো কিন্তু সমান তালে আসছে। নিজের অজান্তে হাঁটতে হাঁটতে আনেকটা দূরে চলে যাই। পানি কিন্তু একই পরিমানে আছে। চার দিকটা দেখতে কেমন সুন্দর লাগছে। হঠাৎ একটু দূরে দেখি, কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। আমি একটু দ্রুত ঐ দিকে যাই। একটু যেতেই দেখি একটা মানুষ, আরও কাছে গিয়ে দেখি, মেয়ে মানুষ। তার হাতে শাঁখা, পলা, গলায় চেইন, কানে বড় দোল টানা দিয়ে আটকানো। তার শরীরে কাপড় নেই। তার গোপন অঙ্গে ছুরি মতন কিছু একটা ঢুকানো, স্তন দুইটা কাটা। কি যে বিভৎস দৃশ্য তা বলে বুঝাতে পারবো না। দেখে আমি ভয়ে চিৎকারও দিতে পারছি না। মনে হচ্ছে মাটির সঙ্গে লেগে গিয়েছে। ঐ লাশটা বুঝি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সে যেন চিৎকার করে বলছে, আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। সেই চিৎকার আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আমি এ অবস্থায় কি করবো বুঝতে পারছি না। তারপর কি হয়েছিল আর বলতে পারি না। যখন আমার হুঁশ এল, দেখি, আমি বাড়িতে।
তার পরদিনই শুনি মানুষ কানাকানি করছে, মিলিটারিরা নাকি গ্রামে ক্যাম্প করে। ঐ দিন দুপুরে আমরা সবাই খেতে বসেছি, এমন সময় শুনি মিলিটারি আসছে। তখন সবাই খাবার ফেলে দৌড়ে পালাচ্ছি। ঘর থেকে বাহির হতেই দেখি, মিলিটারিরা দল বেঁধে জুতার শব্দ করে আসছে। তখন কে যেন আমাকে বলছে, মিলিটারিরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। আমরা বেশি দূর যেতে পারবো না। চল, পুকুরে নেমে যাই। জান মান বাাঁচাতে চাইলে, পুকুরে গিয়ে ডুব দিয়ে থাকি। তখন তো আমাদের সবার বাড়ির চার পাশে ছোট ছোট পুকুর ছিল। পুকুরের পানিতেই সব কিছু হতো। তার কথা শুনে আমি পাশের পুকুরে ঝাঁপ দিলাম। পুকুরে বেশি পানি ছিল না। আমার কোমর পর্যন্ত পানি। সেই পানিতেই আমি বসে পড়ি। গলা পর্যন্ত পানির নীচে ডুবিয়ে রাখি। আর পাতা-টাতা দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাখি। পুকুর থেকেই শুনতে পাচ্ছি চিৎকার, চেঁচামেচি, বাঁচাও বাঁচাও এ ধরনের। আর এ দিক দিয়ে মাছ আমার সারা শরীরে ঠোকর দিচ্ছে। মাছ হয়ত ভেবেছিল, আজ এত বড় খাবার পেয়েছি, মজা করে খেয়ে নিব। আর আমার চোখের সামনে দিয়ে ছোট দুইটা সাপ ঘোরাফেরা করছে। যদিও তারা আমাকে কিছুই করেনি। কিন্তু ভয়ে তো আমি পাথর হয়ে গিয়েছি। আমি বুঝতে পারছি, বিষাক্ত সাপ আমাকে মারবে না। মারবে আমার মতন মানুষ রুপি জানোয়ার। বিষাক্ত সাপও বুঝতে পেরেছিল যে, আমি তাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছি। তাই তারা সেইদিন আমাকে পাহাড়া দিয়েছিল। পরিস্থিতিটা এমন ছিল।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক