বুদ্ধিজীবীদের কতটুকু স্মরণ করতে পারি, তা নিয়ে সংশয় আছে
আমি বিস্মিত হই যে, শুধু ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। ইতিহাস বলছে, অপারেশন সার্চ লাইটের শুরু থেকেই, অর্থাৎ ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত থেকেই বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু হয়। সে রাতেই আমরা হারিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কৃতি শিক্ষক এবং পণ্ডিত মানুষকে। ড. জি সি দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. মনিরুজ্জামানসহ আরও অনেককেই হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে বুদ্ধিজীবীদের তুলে নেওয়া হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে। সেটি সারাদেশেই হয়েছে।
১২ ডিসেম্বরে আলবদর, রাজাকার বাহিনী কর্তৃক দেশের বুদ্ধিজিবীদের হত্যা করতে তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী, তারা ঢাকাসহ দেশের সব জায়গা থেকে বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। শেষ মুহূর্তের আঘাত হিসেবে আমরা বুদ্ধিজীবীদের হারালাম।
১৪ ডিসেম্বরে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি হচ্ছে, তখন আমি মোহসিন হলের সহকারী শিক্ষক। ঘুম থেকে উঠে দেখি–আমাদের বাসায় পানি নেই। বুঝলাম, পানির কল ছাড়ার মানুষটি আসতে পারেনি সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকার কারণে। মোহসিন হলের পেছনের পশ্চিম কোনায় যে পানির ঘরটি আছে, আমি সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি মেশিনের কোনো শব্দ নেই। আমি অযান্ত্রিক মানুষ, মেশিন কীভাবে চালাতে হয় জানি না। আমার পর এলেন আমাদের একজন আবাসিক শিক্ষক জহুরুল হক। তিনি ছিলেন দর্শনের শিক্ষক। সবশেষে এলেন আমার প্রিয় শিক্ষক শহিদ গিয়াস উদ্দীন আহমেদ। পরনে ঘুমের পোশাক। তিনজন মিলে আলোচনা করে স্যারকে বুদ্ধি দিলাম। বললাম, স্যার হ্যান্ডেলটা অফের দিকে আছে, সেটা অনের দিকে দিলে কেমন হয়। স্যার সেটা অনের দিকে দিলেন এবং একটা শো শো শব্দ শুনতে পেলাম। একসময় দেখলাম পানি আসতে শুরু করেছে।
বেশ হৃষ্টচিত্তে বেড়িয়ে যাব, সেই মুহূর্তে ছোট্ট দরজার কাছে এসে দাঁড়াল আলবদর–ছাইরঙ্গের পোশাক, মুখে রুমাল বাধা। গিয়াস স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর ইউ মিস্টার গিয়াস?’ গিয়াস স্যার উত্তর দিলেন, ‘ইয়েস দ্যাটস মি।’ পরক্ষণেই গিয়াস স্যারের বুকে বন্দুক তাক করে উর্দুতে বলল, ‘হামারে সাথ আইয়ে।’ বাঙালি উর্দুতে উচ্চারণ করলে যে বিকৃত শোনা যায়, সেটি সেদিন শুনেছিলাম। যা-ই হোক, গত্যন্তর না দেখে গিয়াস স্যার আলবদরের অনুগামী হলেন। শেষ কথাটি আমার সঙ্গে হলো। বললেন, ‘আনোয়ার, চলি, দোয়া করো।’ আমরা হতভম্ব দুজনেই। স্যারকে নিয়ে গেল।
বাইরে বেড়িয়ে দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছে মোহসিন হলের অবাঙ্গালি দারোয়ান রহিম। তার কাঁধে একটি গামছা ছিল। সেটি দিয়ে স্যারের চোখ বেঁধে নিয়ে গেল। এটাই শেষ দেখা স্যারের সঙ্গে।
তাঁর মরদেহ [ঘুমের পোশাক পরা] শনাক্ত করতে পেরেছিলাম এবং সেটি দাফন করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গিয়াস স্যার হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলাম আমি। সাক্ষ্য দিয়েছি দুদিন। আমার কাছে দুঃখ লাগে এজন্য যে, যারা শহিদ শিক্ষক অন্তত যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক তাদের অনেকের সাথে ঘনিস্টতা ছিল। আমি স্নেহভাজন ছিলাম। তাদের লালিত সপ্ন সম্পর্কে আমার জানা ছিল। তারা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশ তো আজকের বাংলাদেশ নয়।
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা মুক্তচিন্তার পীঠস্থান। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, জামাতপন্থী শিক্ষক আছে। সেটি বড় দুঃখ লাগে। আমি বিশ্বাস করি, বুদ্ধিজীবীদের যে স্বপ্ন ছিল, তা ধারণ করেই বঙ্গবন্ধু ৭২-এর সংবিধান করেছিলেন। সেই সংবিধান আজ ক্ষত-বিক্ষত দলিল। বিকৃত হয়ে গেছে চেতনার দিক থেকে এবং কাঠামোর দিক থেকে।
আরেকটি দুঃখের কথা বলি–আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আজও শহিদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা তৈরি করতে পারিনি। এটি আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা–বিশেষ করে সরকারের ব্যর্থতা।
বর্তমান সরকার ১৩ বছরেরও বেশি ক্ষমতায়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কি কাজ করেছে, আমি বুঝি না। তাদের তো দায়িত্ব ছিল শহিদ বুদ্ধিজীবীদের এই তালিকা আমাদের হাতে দেওয়ার। অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ অনুষ্ঠান বা চর্চা হওয়ার কথা ছিল, সেটিও আমি দেখছি না। এটা আমার কাছে এক বিপন্ন বিস্ময়।
আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি, ১৯৭১ সালে সারা বাংলাদেশে এক হাজার ১১১জন বুদ্ধিজীবী শহিদ হয়েছেন। এই বুদ্ধিজীবীদের আমরা কতটুকু স্মরণ করতে পারি, তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। বাঙালি দান গ্রহণ করতে পারে দু’হাত ভরে। বাঙালি জ্বলে উঠতে পারে। তবে দানকে অর্জন করে কখনোই স্ফিত হতে পারে না। তার বড় প্রমাণ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমাদের উপেক্ষা, উন্নাসিকতা। শেষে সে কথায় ফিরে যাই, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমরা অনেকটাই এগিয়েছি; কিন্তু যেতে হবে বহুদূর।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
শ্রুতিলিখন: শেহনাজ পূর্ণা
এসএ/