ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্য আর ট্রাকে ঝুলন্ত মা
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে আর হতাশায় ভেঙে পড়া মানুষের ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। এক বছরে ৭ বার তেলের দাম বাড়িয়েছে বিপণন সংস্থাগুলো। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলেছে, গত ১৫ দিনে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। অবশ্য তারা বলেনি ব্যবসায়ীদের মধ্যে সাধু চক্র আছে কি না, থাকলে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কী?
টিসিবি ভর্তুকি মূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করে। টিসিবির ট্রাক থেকে দুই লিটার সয়াবিন তেল কেনা যায় ২২০ টাকায়, বাজারে যা ৩৫০ টাকার বেশি। টিসিবি চিনি বিক্রি করে ৫৫ টাকা কেজিতে। বাজার থেকে চিনি কিনতে দাম পড়ে কেজিপ্রতি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। টিসিবি মসুর ডাল বিক্রি করে ৬৫ টাকায়, যা বাজারে ৯৫ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। বাজার থেকে যে পেঁয়াজ কিনতে ৫০ টাকা লাগে, একই পেঁয়াজ টিসিবির ট্রাক থেকে ৩০ টাকায় কেনা যায়। তেল, চিনি, পিঁয়াজ, ডাল এই চার পণ্য বিক্রি হয় টিসিবির ট্রাক থেকে। প্রতিদিন ১৫০টি ট্রাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে টিসিবি পণ্য বিক্রি করে। প্রতি ট্রাকে ২৫০ জন মানুষ পণ্য পেতে পারেন। সেই হিসেবে দিনে ৩৭ হাজার ৫০০ মানুষ পণ্য পাবেন; কিন্তু ঢাকা শহরে দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা তো ১ কোটিরও বেশি, যাদের মধ্যে ৪০ লাখের বেশি বস্তিবাসী। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের এই পার্থক্যের কথা জেনে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে সেই সকাল থেকে, ট্রাক আসে ৯টায়। বাজারদর আর টিসিবির পণ্যের দরের যে পার্থক্য, তাতে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা সাশ্রয় হয় একজন ক্রেতার। যাদের কাজ না করলে চলে না তারা লাইনে দাঁড়াতে পারেন না কারণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কমপক্ষে ৫ ঘণ্টা। ফলে লাইনে বৃদ্ধ, নারী এবং কর্মহীনদের সংখ্যা বেশি। একজন মন্ত্রী একবার বলেছিলেন এখন প্যান্ট শার্ট পড়া মানুষও ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন।
গত ৪ বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। যদিও মন্ত্রী বলেছেন, মোটা চাল এখন গরুকে খাওয়ানো হয়, হয়তো তার বিবেচনায় যারা মোটা চাল খান তারা গরুর পর্যায়ে পড়ে। খাবারের তেল সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৯৪ শতাংশ, গ্যাসের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ এবং মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে ১১৫ শতাংশ, সরকার ঘোষিত মূল্যস্ফীতি গড়ে বছরে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থাৎ ৪ বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ। তবে সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি কত? মন্ত্রী বলেছেন, আয় বেড়েছে দুই-তিন গুণ অর্থাৎ ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ। সে কারণেই না কি জিনিসের দাম বাড়লেও মানুষের কষ্ট হচ্ছে না। না খেয়ে কোনো মানুষ তো মরছে না। আর একজন তো বলেই ফেললেন, এখন একজন শ্রমিক যা আয় করে, তা দিয়ে না কি দিনে ২০ কেজি চাল কিনতে পারে! অর্থাৎ দিনে ১১০০ টাকা আয়, সেই হিসাবে মাসে ৩৩ হাজার টাকা আয় করে এমন শ্রমিক কোথায় বা কয়জন তা কি জিজ্ঞেস করা যাবে?
এটা অবশ্য সত্যি যে, দেশে একদল এমন মানুষ আছেন যারা তাদের আয় দিয়ে দিনে ২০ টন চাল কিনতে পারবেন। তাদের আয়ের উৎস, পরিমাণ এবং তাদের মান-সম্মানের কথা জানতে না চাওয়াটা শুধু ভালো নয়, নিরাপদও বটে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অসহনীয় মুল্য বৃদ্ধি কি প্রভাব ফেলে আমাদের জীবনে আর দেশের ভবিষ্যতে? একজন অযোগ্য দরিদ্র্য মানুষ (মাথাপিছু ২৫৫১ ডলার আয়ের দেশে দরিদ্র্য থাকাটা অযোগ্যতা) যদি দিনে ১.৯ ডলার বা ১৬৫ টাকার বেশি আয় করেন তাহলে তিনি না কি আর দরিদ্র্য থাকবেন না। তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনে মিলে মাসে ৯ হাজার ৯০০ টাকা আয় করলে তারা দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে যাবেন। যদিও মাথাপিছু আয়ের হিসেবে তাদের আয় হওয়ার কথা ৩৭ হাজার টাকা। এই টাকা উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ থাকলেও টাকার ভাগ তারা পাবেন না। ধরে নেই তাদের বাবা মা নেই, সন্তান সন্ততি নেই, ভাই বোন নেই, কারো প্রতি কোন দায়িত্ব নেই। তারা দুজন হংস মিথুন, কাজ করে, আয় করে, খায় আর ঘুমায়। তাহলেও কি এই আয় করে ন্যূনতম খাদ্য পুষ্টি পাবেন? অথচ এরাই তো আমাদের শ্রমজীবী যুবশক্তি! আমাদের ভবিষ্যৎ শ্রমশক্তি আসবে তাহলে কোথা থেকে, যারা আসবে তারা কি ধরনের স্বাস্থ্য পুষ্টি আর শিক্ষা নিয়ে বড় হবে? এই জনগোষ্ঠী তো দেশে ১২ কোটির বেশি।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৮২ লাখ। যাদের ৯০ শতাংশ কাজ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এদের কথা না হয় নাই ভাবলেন কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু যাদের মাসিক আয় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার এই পরিবারগুলো কিভাবে চলছে? যাদের আয় ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার তাঁরা কি টিসিবির ট্রাকে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে পারেন? তাদের সংসার তাঁরা কিভাবে চালান? টিসিবির হিসাবে, ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোটা চালের দাম ৩২ শতাংশ, সরু চাল ২৮ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিন তেল ৫৫ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেল ৮২ শতাংশ, মোটা দানার মসুর ডাল ৬৩ শতাংশ, চিনি ৩২ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ২১ শতাংশ, খোলা আটা ২২ শতাংশ ও এলপি গ্যাসের দাম ১৮ শতাংশ করে বেড়েছে।
মন্ত্রী যতই ভাত কম খেতে বলুন না কেন ভাত ছাড়া আর কি খাবে অল্প আয়ের মানুষেরা? সাধারণ হিসেবে শ্রমজীবী পাঁচজনের একটি পরিবারে মাসে ৪০ কেজি চাল লাগে। টিসিবির মূল্যতালিকা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ৪০ কেজি মোটা চাল কিনতে লাগত ১ হাজার ৪৫০ টাকা। আর গত মাসে লেগেছে ১ হাজার ৯০০ টাকা। তার মানে শুধু চাল কিনতেই খরচ বেড়েছে ৫০০ টাকার মতো।
মন্ত্রীদের দায়িত্ব মন্ত্রণালয় সামলানো যাতে জনগণকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা যায়। কিন্ত যে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন, মন্ত্রীদের বেতন ভাতা চলে সেই জনগণকে তাচ্ছিল্য বা উপহাস করা হলে তাকে কি অপরাধ বলা যাবে না? দারিদ্র্য কষ্ট দেয় কিন্তু অপমান জ্বালা ধরায়। কতখানি আর্থিক টানাপোড়নে পড়লে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে গরমে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন তা বুঝতে হলে বাজারে জিনিসের দাম আর পকেটে টাকার পরিমাণ কত তা কি একটু খেয়াল করবেন না? নাকি নিজেদের অবস্থান থেকে দেখবেন? খরচ বেড়েছে কিন্তু আয় বাড়েনি যে মানুষদের তাদের প্রতি রাষ্ট্রের কি কোন দায় থাকবে না। ট্রাকের পিছনে মাকে দৌড়াতে দেখে বুকের মধ্যে কষ্ট জাগে না কি নীতি নির্ধারকদের মনে? ইউরোপে দাম বেড়েছে এ কথা বলার আগে ভাববেন না কি ইউরোপের মানুষের আয় রোজগার কেমন? সংসার বাঁচাতে, নিজে বাঁচতে প্রাণপণ কষ্ট করছে যে মানুষেরা তাঁরা সহযোগিতা না পেলেও অপমানিত যেন না হন মন্ত্রী মহোদয়দের কাছে, এতটুকু চাওয়া পূরণ না হলে চাপা বেদনা বিক্ষোভে পরিণত হবে।
পণ্য না পেয়ে মধ্যবয়সী মা ছুটছেন এবং ঝুলছেন ট্রাকের পিছনে পিছনে। ট্রাক খালি, যা কিছু মালপত্র ছিল সব শেষ কিন্তু মানুষের লাইন শেষ হয়নি। অপেক্ষায় আছেন আরও অনেকে। কী আর করবেন টিসিবির কর্মচারীরা! তারা ট্রাক নিয়ে চলে যাচ্ছেন। লাইনে দাঁড়ানো মানুষেরা ট্রাকের পিছনে পিছনে ছুটতে শুরু করলেন। এক মা ট্রাকের পিছনের ডালা ধরে ঝুলে পড়লেন। ট্রাক চলছে, মা ঝুলছেন। এই ছবি দেখেছেন অনেকেই। কিন্তু মায়ের বুকের কান্না কি দেখতে পেয়েছেন আমাদের দেশের মন্ত্রীসহ কর্তাব্যক্তিরা?
লেখক: সহকারী সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাসদ
এসএ/