‘নিজেদের টাকার পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চালাতে পারব না কেন’
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রবিবার (৯ এপ্রিল) বলেছেন, আসন্ন ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষ জাতীয় মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিয়ে চলাচল করতে পারবে, তবে শুধু পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। সেতুমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর মোটরসাইকেল চালকেরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের প্রশ্ন, সব জায়গায় মোটরসাইকেল যদি চলতে পারে তাহলে পদ্মা সেতু দিয়ে কেন মোটরসাইকেল চলতে পারবে না?
সম্প্রতি বেশ কয়েকজন মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা হলে তারা এমন মন্তব্য করেন। তারা প্রশ্ন করে বলেন, নিজেদের টাকায় তৈরি পদ্মা সেতুতে বাইক নিয়ে চলতে পারব না কেন?
চালকদের দাবি, উত্তরবঙ্গের বঙ্গবন্ধু সেতু বা অন্যান্য সেতু দিয়ে যদি মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে তাহলে দক্ষিণবঙ্গের পদ্মা সেতু দিয়ে কেন মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না? মোটরসাইকেল কি টোল দেয় না? নাকি এর রোড পারমিট নেই? সরকার এই যানবাহন থেকে তো ভ্যাট নেয় তাহলে এমন সিদ্ধান্ত কেন?
হানিফ ফ্লাইওভার ব্রিজে ওঠার আগে মোটরসাইকেল চালক জসিমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কি এমন সেতু হলো যে মোটরসাইকেল চলবে না? ঈদের সময় শতভাগ বাস পাওয়া যায় না। আমি প্রতি বছরই মোটরসাইকেল চালিয়ে শরীয়তপুর আমার গ্রামের বাড়িতে যায় কিন্তু এই ঈদে যেতে পারব না মনে হচ্ছে। মোটরসাইকেল তো একটি যানবাহন, পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল কেন চলবে না সেটি আমার বুঝে আসে না? আমার টাকার পদ্মা সেতুতে বাইক নিয়ে চলতে পারব না কেন?
বাসযোগে গ্রামের বাড়িতে যেতে পথে পথে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয় এজন্য প্রতি বছর মাগুরায় মোটরসাইকেল চালিয়ে যান মেহেদী হাসান, পদ্মা সেতু দিয়ে তিনি এবার বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পদ্মায় মোটরসাইকেল না চলায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এবারও মনে হচ্ছে পদ্মা সেতু আমার কোনো উপকারে এল না। দৌলতদিয়া- আরিচা ঘাট দিয়ে গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। এটা খুবই দুঃখজনক।
প্রতি বছর দৌলতদিয়া ও আরিচা ঘাট হয়ে বাড়িতে যান নড়াইলের মো. জসিম। জসিম বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে বাড়িতে গেলে আমাদের অনেক সময় কম লাগে। ঈদের সময়মতো গাড়ি পাওয়া যায় না, এজন্য নিজের মোটরসাইকেলে চলে যায় অথচ পদ্মা সেতু হওয়ার আগে এ রাস্তা দিয়ে ফেরি অথবা লঞ্চে যাওয়া গেছে এখন কোনোভাবেই মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যাবে না। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। পদ্মা সেতু হয়ে আমাদের মোটরসাইকেল চালকদের তেমন কোনো লাভ হলো না।
সেতু হওয়ার আগে এই রাস্তা দিয়ে মোটর সাইকেলযোগে চলাচল করতেন মোহাম্মদ মাসুদ রানা। মাসুদ অভিযোগ করে বলেন, সব জায়গাতে মোটরসাইকেল চললে পদ্মা সেতুতে কেন চলবে না? আমি মনে করি এটা সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে। আমরা দক্ষিণবঙ্গের মানুষ গ্রামের বাড়িতে তাহলে কিভাবে যাব? তিনি বলেন, সবার জন্য বাসের টিকিট নিশ্চিত করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।
প্রতি বছর ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মটরসাইকেলে পরিবার নিয়ে বাড়িতে যান মো. জামাল হোসেন। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল কি টোল দেয় না? নাকি এর রোড পারমিট নেই? সরকার এই যানবাহন থেকে তো ভ্যাট নেয় তাহলে এমন সিদ্ধান্ত কেন?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ আন্দোলনের সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কিছু কিছু দেশে সরকার কিছু কিছু যানবাহনের উপরে চলাচলের একটি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকেন। ওই সব নির্দেশনা কিছু কিছু এলাকাভিত্তিক হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকার এমন আইন তৈরি করেনি যে রাস্তায় মটরসাইকেল চলবে না। কাজেই পদ্মা সেতু দিয়ে কেন মোটরসাইকেল চলবে না সরকারের এক্সপার্ট যারা আছেন তারা এই বিষয়ে যুক্তি দেবেন হয়তো।
তিনি বলেন, অন্যান্য যানবাহনের মতো মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন করা হয়। রোড পারমিটও রয়েছে, তাহলে মোটরসাইকেল পদ্মা সেতু দিয়ে কেন চলবে না সেটাই আমাদের বড় প্রশ্ন? পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল না করার কোনো কারণ আমরা দেখছি না। সবাই চলতে পারলে মোটরসাইকেল অবশ্যই চলবে কেন মোটরসাইকেল বন্ধ করা হলো সেই জবাব সরকারের জনসম্মুখে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু সেতুসহ দেশের অন্যান্য সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল করলেও পদ্মা সেতুতে নিষিদ্ধ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় মাইলফলক স্থাপন করা এই সেতুতে দীর্ঘ ৯ মাসের বেশি সময় বাইক চলাচল বন্ধ রয়েছে। সেতুটি চালুর পর প্রথম ঈদুল ফিতর হচ্ছে এবার। মোটরসাইকেলের খসড়া নীতিমালা সামনে আসায় বাইকারদের অনেক প্রশ্ন। পদ্মা সেতু দিয়ে প্রথম ঈদযাত্রায় কোনো মোটরসাইকেল চলবে না। অন্য সেতু দিয়ে চলাচল করলেও পদ্মা সেতুতে কেন নয়?
কর্তৃপক্ষ বলছে, পদ্মা সেতুতে দুর্ঘটনা এড়াতে এবং সেতুটি নিরাপদ রাখতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত ৯ মাসে সেতু দিয়ে বাহনটি চলাচল করতে দেওয়া নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। শিগগিরই নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনাও নেই। ফলে এবারের ঈদযাত্রায় বর্তমান আদেশ বহাল থাকছে—মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না।
আদেশ বহালের বিষয়টি নিশ্চিত করে সম্প্রতি বনানীর বিআরটির কার্যালয়ে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন-২০২৩ উপলক্ষে সড়কপথে যাত্রীদের যাতায়াত নিরাপদ করতে মতবিনিময় সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মোটরসাইকেল চলাচলের বিষয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলবে না, এটি কি আমরা বলেছি? তবে শুধু পদ্মাসেতু বাদে সব মহাসড়কেই মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে।
সেতুমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর বাইকচালকেরা বিভিন্নভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, এটা সরকারের কেমন সিদ্ধান্ত।
২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করার পরদিন যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় পদ্মা সেতু। প্রথম দিনে বিপুল সংখ্যক বাইক সেতুটি দিয়ে পার হয়। এর মধ্যেই ওই দিন রাতে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুজন মারাত্মক আহত হন এবং এর মধ্যে একজন মারা যান। ওই দুর্ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। পরদিন সেতুটি দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার।
এরপর এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৭ জুন সকাল ছয়টা থেকে পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ থাকবে। গণবিজ্ঞপ্তি নিয়ে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য না করলেও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীরা। তারা বলছেন, এক দেশে দুই নীতি চলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে বাইক চলাচল করতে সমস্যা না হলে পদ্মা সেতুতে কেন নিষিদ্ধ থাকবে। সামনেই ঈদুল ফিতর, তখনো কি এই সেতু দিয়ে বাইক চলাচল বন্ধ থাকবে?
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অতিরিক্ত পরিচালক (পদ্মা সেতু সাইট অফিস) বলেন, পদ্মাসেতু দিয়ে মটরসাইকেল চলাচলের এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তা ছাড়া এই বিষয়ে আমাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মটরসাইকেল চলাচলের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়েছেন। আপাতত আমরা এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। পদ্মা সেতু দিয়ে বাইক চললে একটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যেমে সবাইকে জানানো হবে।
এদিকে গত ২৯ মার্চ পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের নির্দেশনা চেয়ে দায়ের করা রিট আবেদনের উপর আরও ৪ সপ্তাহের জন্য স্ট্র্যান্ডওভার (মুলতবি) করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, এ চার সপ্তাহের মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটা দেখে পরবর্তী আদেশ দেবেন। তার মানে আরও এক মাস পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচলের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিট আবেদন করা আইনজীবী তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের রিটের আবেদনের উপর আদালত একটি সময় দিয়েছেন। বর্তমানে রিটটি মুলতবি করেছেন হাইকোর্ট।
আরইউ/এসএন