‘একটা লক্ষ্য নিয়ে জীবন বাজি রেখে দেশে ফিরেছিলাম’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর এমন একটি অবস্থার মধ্যে আমি জীবনকে বাজি রেখে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলাম, একটা লক্ষ্য নিয়ে।
বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) সকালে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০২১ এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স-২০২১ এর গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
তিনি বলেন, যে জাতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে, সেই জাতি অন্ধকারে পরে থাকবে কোনো উন্নতি হবে না, তাদের জীবন ধরণ উন্নতি হবে না, এটা তো হতে পারে না। আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। গড়ে তুলতে হবে বাংলাদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে এবং সেই লক্ষ্য নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতি কাতর হয়ে ছোট ভাই শেখ রাসেল সম্পর্কে বলেন, রাসেলের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল সে বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। কিন্তু তার সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। ঘাতকের বুলেট তাকে কেড়ে নেয়। আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে একটি রাষ্ট্র জাতির পিতা উপহার দেন। যেটা ছিল একটা প্রদেশ, সেই প্রদেশটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রে তিনি উন্নীত করেছিলেন এবং আমাদেরকে একটা জাতি হিসেবে মর্যাদা দিয়েছিলেন। বিশ্ব জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
তিনি বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) যুদ্ধবিধস্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলার যাত্রা শুরু করেন ১৯৭২ সালের বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে যখন তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার সাথে সাথে তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উপযোগী এবং প্রয়োজনীয় সশস্ত্র বাহিনীও গড়ে তোলেন। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের বাঙালিদের জন্য একটি শক্তিশালী পেশাদার সশসস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলবেন। ১৯৭২ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটানি সেনাবাহিনীর অস্থায়ী একাডেমি গড়ে তোলেন। চট্টগ্রামের জায়গাটাও তিনি নির্দিষ্ট করেন এবং দেখে রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা সব সময় গণ মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের কথাই চিন্তা করতেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ যারা দরিদ্র, যারা ক্ষুধার্থ, যাদের কোনো মাথা গোঁজার ঠাই ছিল না, যারা রোগে চিকিৎসা পেতো না, যারা শিক্ষা পেতো না, সেই মানুষগুলো ভাগ্য পরিবর্তন কথা তিনি চিন্তা করেছেন। শুধু বাংলাদেশের না তিনি সমগ্র বিশ্বের দরিদ্র নিপিড়িত মানুষের কথাও তিনি সব সময় আন্তর্জাতিক যে কোনো জায়গায় বলেছেন এবং তিনি তা বিশ্বাস করতেন।
শেখ হাসিনা বলেন, সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয় এই পররাষ্ট্র নীতিতে জাতির পিতা বিশ্বাস করতেন। আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বে একটা মর্যাদা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তি এদেশীয় দোসররা আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতাকে ম্লান করে দেয়। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দেয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতার আদর্শ চেতনা সেটা ভুলণ্ঠিত হয়। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে আর্থ সামাজিক পথ উন্নয়নে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে জাতির পিতা সে সময় প্রবৃদ্ধি ৯ ভাগের উপরে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল দূরবার গতিতে কিন্তু সেটা স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর ২১ বছর বার বার সামরিক বাহিনীতে ক্যু হয়, প্রায় ১৯ বার ক্যু হয়েছে। কত সামরিক অফিসার, জোয়ান, সৈনিক সাধারণ মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। অনেক পরিবার এখনো তাদের আপনজনের সন্ধান পায়নি। এমনই একটা অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে ২১ টা বছর কেটেছে। ২১ বছর পর ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট যখন এদেশে হত্যাকাণ্ড ঘটে আমার ছোট বোন আর আমি আমরা তখন জার্মানিতে ছিলাম। বিদেশে ছিলাম এজন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। এরপর যারা ক্ষমতা দখল করেছিল আমাদের দেশে আসতে দেয়নি। রিফিউজি হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়েছে। এমনকি নিজেদের নামটা পরিচয় দিতে পারিনি, কারণ যারা আশ্রয় দিয়েছিল এটা তাদেরই ইচ্ছে ছিল। ১৯৮১ সালে যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমার অবর্তমানে আমাকে সভাপতি করে আমিও দেশে ফিরে আসার জন্য অস্থির ছিলাম। এক রকম জোর করেই অনেক বাধা অতিক্রম করে আমি ঝর ঝাঞ্জা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আসি। এমন একটা সময় ফিরে আসি যেখানে আমার বা মা ভাই ছোট্টা শিশু রাসেল তাকে পর্যন্ত হত্যা করেছে তারাই তখন ক্ষমতায়, তার কারণ তাদের ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল বিচার করা হবে না বলে। সেটাই আইন করা হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধী যারা গণহত্যা করেছিল, তারাই ছিল ক্ষমতায়। আর খুনিরা বিভিন্ন দূতাবাসে তখন আমাদের রাষ্ট্রদূত অথবা প্রতিনিধি। এমন একটি অবস্থার মধ্যে আমি জীবনকে বাঁজি রেখে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলাম একটা লক্ষ্য নিয়ে, যে স্বাধীনতার জন্য আমার বাবা তার সারাটা জীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন, বছরের পর বছর জেল খেটেছেন, আমরা ভোই বোনেরা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি, আমার মা পাশে থেকেছেন প্রেরণা দিয়েছেন, শক্তি সাহস জুগিয়েছেন। এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রে তার পদচারণা ছিল নিরবে। যে জাতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে, সেই জাতি অন্ধকারে পরে থাকবে কোনো উন্নতি হবে না তাদের জীবন ধরণ উন্নতি হবে না এটা তো হতে পারে না। আমাদের ফিরে আনতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। গড়ে তুলতে হবে বাংলাদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে এবং সেই লক্ষ্য নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।
দেশ গড়ার লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যার কারণে সমগ্র বাংলাদেশ আমি ঘুরে বেড়াই। কোথায় কি অবস্থায় মানুষ বসবাস করছে। আমার একটা লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে গড়ে তুলব ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র মুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আর সেই আদর্শ নিয়েই কাজ শুরু করি। সেই সাথে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার যে প্রতিষ্ঠান যেখানে বার বার আঘাত এসেছে, ক্যু হয়েছে সেখানে এটাকে শৃঙ্খলা ফিরে আনা এবং উন্নত করা। একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বিশ্ব সভায় মর্যাদা নিয়ে চলবে সেই আকাঙ্খা নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করি। আমরা সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। আমাদের লক্ষ্য দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে যেন আমাদের সেনাবাহিনী চলতে পারে সেভাবেই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করি। দেশের সার্বভৌম্ব রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে সদাপ্রস্তুত থাকে।