ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৮
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
পরক্ষণে এক চামচ সুজির হালুয়া মুজফফরের মুখের সামনে ধরে বলে, খাও। মুজফফর চট করে খেয়ে নেয়। ভাবে, এটা একরকম খাওয়া না, অন্যরকম। হাসতে হাসতে বলে, বেশ করে খাওয়ালে। পেট ভরে না, কিন্তু মন ভরে যায়।
-মন ভরাতেইতো চেয়েছি। চাইলে পেটও ভরাতে পারব। দেব?
-না, না। তোমার ভালোবাসায় মন ভরিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই।
-বাব্বা, এতবড় কথা বললে।
-বলবইতো। তুমি আমাকে পরীর মতো ভালোবাস। তোমার ভালোবাসায় আমি বাতাসে উড়ি, নদীতে ভাসি, মাটিতে গড়াই।
খিলখিলিয়ে হাসে লুৎফা। হাসতে হাসতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
-হাসছ কেন?
-আনন্দে হাসছি। তোমার কথায় আমার বুক ভরে গেছে। কত সুন্দর করে ভালোবাসার কথা বললে তুমি।
-বলবইতো। ভালোবাসা পেলে বলব না কেন? তুমিওতো আমার ভালোবাসা পাও।
-হ্যাঁ, পাইতো। তোমার কথা আমারও কথা। আমরা দুজনে এক হয়ে দাঁড়িয়েছি সংসারের কাঠগড়ায়।
মুজফফর হা-হা করে হাসে। কাঠগড়া শব্দ শুনে মাথা দপদপ করে ওঠে। লুৎফা হা করে তাকিয়ে থেকে বলে, হাসছ কেন?
-হাসব না কেন? ভালোবাসার সংসারকে তুমি কাঠগড়া বানালে। আমরা কি আসামি?
লুৎফাও হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ, আমরা ভালোবাসার সংসারে আসামি। দুজনে দুজনকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু পারি না। দুজনে দুজনকে ভালোবাসায় খুন করেছি। ঠিক না?
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমিতো আমার পুরো শরীরের ভালোবাসার রক্ত মেখে আছি।
আমিও ভালোবাসার রক্ত মেখে আছি। এই রক্তের রঙ লাল না গোলাপি।
-আমি মনে করি রক্তের রঙ সবুজ। জীবনভর গাছ-গাছালি, অনেকর রকম ফুল, কত পাখি ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায়। আমার সবুজ রঙের ভালোবাসায় সবুজ ছবি ভেসে থাকে। মন ভরে যায় ছবি দেখে। চোখ জুড়িয়ে যায়। তুমি আমার সবুজ প্রকৃতি।
-বাব্বা অনেক কথা বললে।
-এটাতো শুধু কথা না।
-জানি কথা না, ভালোবাসার রক্ত। এই রক্তকে গায়ে মেখে ভালোবাসার বসন্ত বাতাস করি। চলো শুয়ে থাকি। গভীর নিশ্বাস ফেলে ভরিয়ে দেব তাঁবুর ছোট জায়গাটি। বলব, স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এই নিশ্বাস আমার বসন্ত বাতাস।
-বাব্বা, আজ তোমার মনের দরজা খুলে গেছে। হু-হু করে বেরিয়ে আসছে ভালোবাসার বসন্ত বাতাস। যাই, বাইরে দেখি অন্যরা কি করছে।
মুজফফর তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলে লুৎফা মাটিতে বিছানা মাদুরের উপর শুয়ে পড়ে। মাথার নিচে বালিশ নেই। ওর মাথা মাটিতে গড়ায়। নিজেকে বলে, মাথায় মাটি নিয়ে স্বাধীন দেশে যাব। আমার দেশের মাটি আমার বুকে থাকবে। আর সব দেশের মাটি মাথায় থাকবে। আমি মাটি থেকে দূরে থাকবনা। মাটি হবে বেঁচে থাকার উৎস। ভাবতে ভাবতে উপুড় হয়ে মাথা দোলায়। বিড়বিড় করে বলে, আমার মাটি আমার দেশ। আমার মাটি আমার স্বাধীনতা, আমার মাটি আমার স্বপ্ন। মাটিতে মাথা ঘঁষতে ঘঁষতে দুচোখ পানিতে ভরে যায়। লুৎফা একসময় গুণগুণ করে গায়
-‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ একটি লাইনই অনেকক্ষণ ধরে গাইতে থাকে। মাটি আর গানের সুরে ওর শরণার্থী জীবন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওর মাথা সোজা করার ইচ্ছা হয় না। একটুপরে মুজফফর ফিরে এসে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। লুৎফার কন্ঠ থেকে ভেসে আসা গানের মাধুর্য ওকে বিমোহিত করে রাখে। ওর ভেতরে ঢোকার ইচ্ছা হয় না। কারণ ওকে দেখলে থেকে যাবে লুৎফার প্রাণঢালা সংগীত। ও তখন ওর সঙ্গে নানা কথা বলা শুরু করবে। তারচেয়ে এই গুণগুণ ধ্বণি অনেক বেশি আনন্দের। মুজাফফর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেও মাটির ভাবনায় আপ্লুত হয়। এক সময় থেমে যায় লুৎফার কন্ঠস্বর। মুজফফর সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর ভেতর ঢোকে। লুৎফা তখনো মাটিতে শুয়ে আছে। মুজফফর পাশে গিয়ে বসে পিঠে হাত রেখে বলে, চল দুজনে মিলে গানের লাইনটা গাই। তোমার গান আমার বুকের ভেতর নাড়িয়ে দিয়েছে। এই মাটির টানে আমরা স্বাধীন দেশে যাব।
-স্বাধীন দেশের জন্য তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে।
-যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র চালানো শিখতে হবে। কোথায় শিখব জানি না তো।
-আশেপাশে খোঁজ নিয়ে দেখনা।
-তাহলে আমি কালকে চৌগাছায় যাব। দেখব কি করতে পারি।
-হ্যাঁ, যাও যাও। আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
-তুমি গিয়ে কী করবে?
-যুদ্ধ করব। তোমার সঙ্গে থেকে যা করতে হয় তার সব কাজ করব।
-ঠিক আছে। তাহলে আমরা একসঙ্গেই যাব।
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে লুৎফা। হাসতে হাসতে বলে, আমার ভাগ্য ভালো যে তুমি আমাকে না বলোনি। তুমি না বললে আমি কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যেতাম।
-চল, যশোর রোডে হেঁটে আসি।
-চল, দেখি চারদিকের অবস্থা কী।
দুজনে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়ে। হাত ধরে হাঁটে। মুজফফর মৃদু হেসে বলে, দূর থেকে কেউ দেখলে বলবে আপনার বউ কি হারিয়ে যাবে?
-তাহলে হাত ছেড়ে দাও।
-না, ছাড়ব না। তুমি হারাবে কেন? এটা আমার মাথায় নাই। আমি ভালোবাসার হাত ধরেছি।
লুৎফা দুজনের হাত বুকে চেপে ধরে। মুজফফর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আর হাত ধরে হাঁটব না। লোকে হাসবে। দুজনে চুপচাপ হেঁটে এগোয়। দেখতে পায় অঞ্জন গাছের নিচে বসে খবর শুনছে। মুজফফর আর লুৎফা ওর সামনে গিয়ে বসে।
-কি খবর শুনছেন অঞ্জন ভাই?
-খবরটা আমেরিকার। ওখানে নিউইয়র্কে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গানের আসর অনুষ্ঠিত হয়। বলা হয় কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। সব টিকিট বিক্রি হয়েছে।
লুৎফা চেঁচিয়ে বলে, দারুণ খবর জানালেন অঞ্জন ভাই।
-আরও বড় খবর আছে ভাবী। এই টাকা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের দেওয়া হবে। ওখানে একজন গায়ক একটি গান গেয়েছেন যে গানের লাইনে ছিল বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
মুজফফর লাফ দিয়ে দুহাত উপরে তুলে বলে, আমরা এখনও স্বাধীন হইনি। কিন্তু দুনিয়ার মানুষের কাছে বাংলাদেশ নাম পৌঁছে গেছে। ওহ গানটা শুনলে আমরাও গাইতাম বাংলাদেশ বাংলাদেশ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সবাই হাততালি দিয়ে লাফালাফি করে। চিৎকার করে বলতে থাকে, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। চারদিক থেকে লোকজন এগিয়ে আসে
-সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। তিনটি শব্দ আকাশ-বাতাস তোলপাড় করে। যারা শব্দ তিনটি বুঝতে পারেনা তারা অঞ্জনকে বলে, অঞ্জন ভাই আমাদেরকে বলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশ কী? অঞ্জন ওদেরকে বুঝিয়ে দিলে সবাই একসঙ্গে বলে, দুনিয়ার সামনে বাংলাদেশ ফুটে উঠেছে। আমাদের স্বাধীনতার দেরি নাই। আমরা যশোর রোড থেকে মিছিল করে স্বাধীন দেশে ঢুকব। হুররে, বাংলাদেশ. বাংলাদেশ।
চলবে...
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা। পর্ব- ৩৩