ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৪
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
কলকাতা থেকে শরণার্থীদের দেখতে যশোর রোডে এসেছেন আমেরিকার কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। সঙ্গে সুনীল গঙ্গ্যোপাধ্যায়। শরণার্থী শিবিরের দিকে তাকিয়ে মর্মাহত হন গিনসবার্গ। শিশুরা রাস্তার ধারে কিংবা মাঠের এখানে-ওখানে গড়াগড়ি দিচ্ছে। খিদায় কাঁদছে। ওরা খেলাধুলার মধ্যে নেই। গিনসবার্গ চারদিকে তাকিয়ে মর্মাহত হয়।
মানুষের দুঃখ-কষ্টের জীবনযাপন তাদের চেহারায় প্রতিফলিত হয়ে আছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ মানুষদের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ধরে রাখা যায়না। মানুষের কষ্টের চেহারা এভাবে দেখতে পাওয়া এক ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। আগে কখনো দেখা হয়নি। এইসব দেখার অনুভব তার কবিতার লাইনে উঠে আসবে। মনে মনে ঠিক করে কবিতার নাম হবে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। শরণার্থী মানুষের চেহারা দেখে বুকের ভেতর কাঁপন ধরে। সুনীলের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, বুঝতে পারছি ওদের খুব কষ্টে দিন কাটছে।
-কাটবেইতো। সুনীল সার্পোট করে বলে। তারা নিজের দেশের থেকে চলে এসেছে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ভারত সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে নিজেদের সাধ্যমতো।
-বুঝেছি। থাক আর বলতে হবে না। যুদ্ধের পরিস্থিতিতে এমন হবেই। আমি আমেরিকায় ফিরে গিয়ে কবিতা লিখব।
-বেশ, বেশ। সুন্দর ধারণা। আমিও লিখব।
-মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি কি অবস্থা। সবার চেহারায় আছে দুঃখ-কষ্টের ছাপ। আরও নানা বর্ণনা করতে পারব। কষ্টের সীমারেখায় কবিতা লেখা হবে। আরও কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে তারপর চলে যাব। যশোর রোডের শরণার্থী শিবির আমার জীবনের নতুন শিক্ষা। জীবনযাপন দেখার নতুন বৈচিত্র্য। এই সময় কলকাতায় না এলে আমার দেখা হতো না। তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই সুনীল।
-পূর্ববঙ্গ স্বাধীন বাংলাদেশ হবে এটা আমার বিশাল প্রত্যাশা। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব বাঙালিকে সচেতন করে তুলেছে। বাঙালি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হবে এ বড় গৌরবের জায়গা। আমিতো মনে করি স্বাধীনতার পরে বাংলা ভাষা হবে রাষ্ট্রের ভাষা। সুনীলের এমন প্রত্যাশা মুগ্ধ করে অ্যালেন গিনসবার্গকে। বাঙালির সেই স্বপ্ন পূরণ হবে এটা নিয়ে নিজেও উদ্বুদ্ধ হয়। ও সুনীলকে বলে, এমন স্বপ্ন পূরণের জন্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট প্রকৃতির নিয়ম। তোমার মতো আমিও বাংলা ভাষাকে নিয়ে এই স্বপ্ন দেখছি। কবিতায় ধরে রাখব সময়ের পরিধি।
-তোমাকে অভিনন্দন জানাই। কবিতার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করেছ।
-থ্যাঙ্কু। চলো কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই। মানুষের কষ্টের চেহারা আটকে থাকুক বুকের ক্যানভাসে।
সুনীল কথা বাড়ায়না। হাঁটতে শুরু করে। দুজনে এগিয়ে যায়। দেখতে পায় নানাদিকের দৃশ্য একরকমই। সবার চেহারায় কষ্টের ছাপ। ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক লোক। একইসঙ্গে হাঁটছে। অ্যালেন গিনসবার্গ বুঝতে পারে কোনোরকমে বাস করার ঠাঁই করে নিয়েছে সবাই। কিন্তু পর্যাপ্ত খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। এতকিছু দেখে ভীষণ মর্মাহত হলেন তিনি। মানুষের এভাবে দিনযাপন মানবিকতার ছোঁয়া না। কিন্তু কিছু করারও নই। যুদ্ধ শেষ হলে স্বাধীনতার বরণডালা মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরবে সবাই। এই শুভ ধারণা নিয়ে ফিরে যায় দুজনে। মাঝপথে দেখা হয় অঞ্জনের সঙ্গে। অঞ্জন সুনীলকে চিনতে পারে। কাছে গিয়ে বলে, সুনীলদা আপনি শরণার্থী শিবির দেখতে এসেছেন?
-ইনি আমেরিকার কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। তাঁকে দেখাতে নিয়ে এসেছি। তিনি আমেরিকা ফিরে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে কবিতা লিখবেন।
-ওহ দারুণ! আপনাকে ধন্যবাদ।
অঞ্জন হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে। অভিভূত হয়।
-আমিও শরণার্থী ক্যাম্পে থাকি স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে। এখানে থাকার কষ্ট অনুভব করিনা।
-দারুণ চিন্তা। আপনাকে অভিনন্দন জানাই। সবার মাঝে এমন চিন্তা ছড়াবেন। কেউ যেন কষ্ট করে না থাকে।
-হ্যাঁ, আমি সবাইকে এটা বোঝাই। তবে সবাইতো একরকম না। অনেকের কাছে কষ্ট প্রধান হয়ে উঠে। তবে স্বাধীনতার স্বপ্ন সবার বুকের ভেতর আছে।
-আমিও তাই মনে করি। কষ্ট সাময়িক। স্বপ্ন থাকে জীবনভর।
-ঠিক, ঠিক। অঞ্জন হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকায়। অ্যালান গিনসবার্গকে দৃষ্টিতে নন্দিত করে। সুনীলকে বলে, দাদা, আপনাদের জন্য কি করতে পারি?
-এখানে কিছু করা যাবে না। আমরা কিছু খাব না।
-কবি কি কারো সঙ্গে কথা বলবেন?
-না, দরকার নেই। আমরা চলে যাই এখন।
-আচ্ছা, আপনাদের সঙ্গে আমিও এগোব।
-কতদূর যাবেন?
-যশোর রোডের শেষ মাথায়।
-চলেন, যাই।
তিনজনে হাঁটতে শুরু করে। দেখতে পায় চারপাশে দুঃখী মানুষরা ঘোরাফেরা করছে। কেউ কেউ তাদের পেছনে আসছে। অঞ্জন অতিথি দুজনের সঙ্গে কথা বলে না। নিজের থেকে কিছু বলার ইচ্ছা হয় না। যারা দেখতে এসেছে তারা দেখুক চারদিক। নিজেদের উপলব্ধি দিয়ে মূল্যায়ন করুক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়।
যশোর রোডের শেষ মাথা এসে দাঁড়িয়ে পড়ে তিনজনে। অ্যালেন বলে, আমার এই শরণার্থী শিবির দেখার অভিজ্ঞতা আমি আজীবন মনে রাখব।
সুনীল বলে, আমিও মনে রাখব। আমার দেখা পূর্ববঙ্গ স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, এটা আমার কাছে গৌরবের অহঙ্কার। বিদায় ডক্টর অঞ্জন।
-গুড বাই ডক্টর অঞ্জন। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লেগেছে।
-আপনিও আমার প্রিয় কবি হয়ে থাকবেন, অ্যালেন গিনসবার্গ।
-থ্যাঙ্কু।
দুজনে সামনে এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠে। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে অঞ্জন। ভাবে, ও নিজেও একদিন বাসে উঠে কলকাতার সল্টলেকের শরণার্থী শিবির দেখতে যাবে। পরক্ষণে মনে হয়, কেমন করে যাবে? ওর কাছে তো ইন্ডিয়ান রুপি নেই। মুহূর্তে পেছনে ফিরে হাঁটতে শুরু করে। দেখতে পায় মাঠের ভেতরে বেশকিছু লোক জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে স্লোগান দিচ্ছে। নিজেও স্লোগান দিতে দিতে ওদের কাছে চলে যায়। ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ওদের মতো দুহাত উপরে তুলে স্লোগান দেয়। উদ্দীপিত হয়। একসময় লোকেরা ওকে জিজ্ঞেস করে, বঙ্গবন্ধুকে আমরা কবে দেখতে পাব ডাক্তার সাহেব?
-জানিনা ভাইয়েরা আমার। আমার মনে হয় পাকিস্তানিদের লাত্থি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার পরে পাকিস্তানের জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা যাবে।
-হুররে.... ঠিক ঠিক। জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা। পর্ব- ৩৩