বর্ষার গল্প
একটি বৃষ্টির রাত
রাত প্রায় সাড়ে আটটা। বহদ্দারহাটের একটা কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তায় কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। সাথে সাথে শুরু হলো আচমকা ঝড়ো-হাওয়া। তাই বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছি একটি দোকানের পাশে। বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বৃষ্টি থামছে না। আশেপাশে অনেকেই ছিলো। সবাই ভিজে ভিজে চলে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। কতক্ষণই-বা দাঁড়াবে? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রাত দশটা পেরিয়ে যাচ্ছে। একে একে সবাই চলে গেলো। আমি এখনও সাহস করে বৃষ্টিতে ভিজতে পারছি না। ভিজবো কি করে! বৃষ্টিতে ভিজলেই সাথে সাথে জ্বর। এ এক রোগ আমার। তার ভেতর তখনও আমার সর্দি-কাশি ছিলো। সময় গড়াতে গড়াতে একসময় ওই দোকানের আশে পাশেও কেউ নেই। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি।
আকাশে প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বজ্রপাতের শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টির মাত্র বেড়ে গিয়েছে। রাত ১১ টা বাজতে আর ২ মিনিট বাকি আছে। বাসা থেকে বাবার ফোন এসেছে। রিসিভ করার আগেই ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মোবাইলের চার্জ শেষ। কি এক যন্ত্রণা!
এবার বাসার সবাই চিন্তা করবে। কোনো রকম বহদ্দারহাট মোড়ে এসে পৌঁছাতে পারলেও গাড়ি পাওয়া যেতো। আমি এখন বহদ্দারহাটের একটি রোডের ভেতর আটকে আছি। এটা দিয়ে সোজা হাজির পুল যাওয়া যায়। আমি নিজেও হাজির পুল থেকে আসছিলাম। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। যে দোকানের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম সেই দোকানদার যাওয়ার সময় বলেছিলো এগারোটা সতেরো বাজে। এখন তো আরও ১০/১৫ মিনিট হয়ে গেছে। আশেপাশে কোনো দোকান খোলা নেই আর। সবকিছু বন্ধ। নেই কোনো আলো। কোনো গাড়ি যাওয়া আসাও করছে না। খালি তো দূরের কথা, যাত্রী আছে এমন কোনো গাড়িও দেখছি না। অপেক্ষা করতে করতে কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। একসাথে অনেক কিছুর ভয়। সন্ত্রাসের ভয়, ছিনতাইকারীর ভয়। এসবকিছুর চেয়েও বেশি ভয় পাচ্ছি অদৃশ্য কিছুর। আমি সচারাচর এমন ভয় পাই না। কিন্তু দোকানদার যাওয়ার সময় ভয়টা ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো।
রাত বারোটা বেজে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজতেই হবে। চারপাশে হঠাৎ অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে দৌড় দিতে। কেমন একটা বিকট শব্দ হচ্ছে। এবার কিন্তু প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে। রাতও অনেক হয়েছে। মোবাইল বন্ধ না থাকলে অন্তত মোবাইলের আলো থাকতো। আর সময়টাও দেখতে পেতাম।
চারপাশের অদ্ভুত শব্দ শুনে আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে আর তিন ঘণ্টা দাঁড়ালেও গাড়ির দেখা পাব না। সমস্যা হচ্ছে বৃষ্টিটাও থামছে না। যার কারণে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা। এভাবে এক জায়গায় একা একা সাড়ে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা খুব সহজ বিষয় না। এবার চোখ বন্ধ করে মাথাটা বৃষ্টির নিচে দিয়ে এগিয়ে চললাম। এমনভাবে এগুচ্ছি যেন পেছন থেকে আমাকে কেউ তাড়া করছে। আমি এগুতে এগুতে আবিষ্কার করলাম আমাকে কেউ অনুসরণ করছে। কিন্তু পেছনে আমি ফিরে দেখছি না। দেখার সাহসও পাচ্ছি না। হাঁটার গতি বেড়ে গেছে আমার। মনে হচ্ছে আমি হাঁটছি না, দৌড়াচ্ছি। একসময় মনে হচ্ছে আমার পেছনে কেউ দৌড়াচ্ছে। এবার থেমে গেলাম আমি। খুব ভয় নিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম।
পুরো শরীর আমার কেঁপে উঠল। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার চেহারা স্পষ্ট না। আমার চেয়ে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জিনিসটি কি মানুষ না অন্যকিছু তা আমি বুঝতে পারছি না। আমি কোনো শব্দ করলাম না। মুখ দিয়ে কিছু বেরও হচ্ছে না। আবারও এগিয়ে যেতে থাকলাম। আমি বুঝতে পারছি সেও আমার পেছনে আসছে। এবার মনে হচ্ছে আমার খুব কাছে এসে গেছে সে। একটু পরই আমাকে ছুঁয়ে ফেলবে। আমি আবারও দাঁড়িয়ে গেলাম। পেছনের সেও দাঁড়িয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমার শরীরের খুব পেছনে সে। সে আসলে কে তা আমি এখনও নিশ্চিত নাই। দাঁড়ানো অবস্থায় ভাবছি কি করবো? সাহস করে পেছনে ফিরব?
না, জোরে একটা চিৎকার দিবো। না, এর আগে জিজ্ঞেস করা দরকার কে সে?
আমি পেছনে না তাকিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি?
কোনো সাড়া শব্দ নেই, আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম কে আপনি?
এবার উত্তর এলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না এটা কি মানুষর শব্দ না অন্যকিছু। নাকি আসলে কিছুই না। সে আমাকে বললে, আমি তোমার সঙ্গী।
আমি এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি বললাম, আমার সঙ্গীর দরকার নেই। আপনি চলে যান। আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই। বাড়ি যাওয়ার ভাড়া আছে শুধু। আর মোবাইলটা নষ্ট। তবুও লাগলে নিয়ে যান।
সে বোধহয় আমার খুব কাছে এসে গেছে। আমার পেছন থেকে কানের কাছে এসে বলে, আমার তোমাকে চাই। আর সাথে সাথে পেছন ফিরে তাকাতেই বিকট একটি চিৎকার দিলাম আমি।
এরপর আর কিছু বলতে পারছি না। বাসায় বাবা-মা সবাই আমার মাথায় পানি ঢালছে। আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?
আম্মু বলল, এখানে কে নিয়ে আসবে মানে? তুই তো এখানেই ছিলি। ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিস।
আমি লক্ষ্য করেছি সবার চোখে পানি, সবাই বোধহয় কান্না করেছে। তবে আমার মাথায় কিছু আসছে না। ওরা কি আমাকে কিছু লুকাচ্ছে? নাকি আমি আসলেই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছি এটা। বাবা-মা বললো আমি খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। কি দেখেছি সেটা জানতে চাইছে তাঁরা।
অথচ আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। বাবাকে যাওয়ার সময় বলেই গেলাম বহদ্দরহাটে আমার একটা কাজ ছিলো। বাবাকে বললাম, তুমি তো আমাকে ফোন দিয়েছিলে। মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে আমার। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখালাম মোবাইল বন্ধ।
বাবা-মা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর বাবা বলল, মোবাইল তো আমার সামনেই বন্ধ করেছিস তুই। রাতে বিভিন্ন ধরনের ফোন আসে। ঘুমোতে পারিস না এজন্য নিজেই বন্ধ করে রেখেছিস।
আমি বাবাকে বললাম, তাহলে তোমার মোবাইলটা দাও। বাবা নিজের মোবাইল এনে আমার হাতে দিলো। আমি দেখলাম বাবার মোবাইলের ডায়াল লিস্টে আমার নম্বর নেই।
তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখেছি? তবুও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন নয়, এটা সত্যি।
লেখক : আজহার মাহমুদ
শিক্ষার্থী : বিবিএ-অনার্স, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ (৩য় বর্ষ), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ওমরগনি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম।
ইমেইল : azharmahmud705@gmail.com
ঠিকানা : সালাম হাইটস (৪র্থ তলা), খুলশী-১, চট্টগ্রাম ৪২০২।