ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩১
দ্য ফার্স্ট ম্যান
অহংকার পতনের আগে আগে চলে-এই সত্য নিয়েই জ্যাকের শিক্ষা যেন পূর্ণতা পায়। সে ভেবেছিল, পরদিন তার বন্ধুদের বাহবার জবাব হিসেবে নিজের অহংকারী আচরণ প্রদর্শন করবে। ক্লাসের শুরুতেই হাজিরার সময় মুনোজের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না; জ্যাকের পাশের বন্ধুরা মুনোজের অনুপস্থিতির বিষয়টাকে কটাক্ষ করে বিজয়ী জ্যাকের দিকে মন্তব্য ছুড়ে দিল এবং চোখের ইশারায় বাঁকা চাহনিতে বাহবা দিল। জ্যাক তাদের প্রতি সাড়া দিতে গিয়ে যেন অহংকারের কাছেই সপে দিল নিজেকে: গাল ফুলিয়ে চোখ আধ বোঁজা অবস্থায় ওদের দিকে যখন সে তাকিয়েছে তখন বুঝতেই পারেনি, এম বার্নার্ড তাকে দেখছেন। তামাশা দেখানোর জন্য অদ্ভূত অনুকৃতির আশ্রয় নিয়েছে জ্যাক; তবে তার চোখের ওই অদ্ভূত চাহনি মিইয়ে গেল যখন সে সুনসান নীরব ক্লাসে এম বার্নার্ডের কণ্ঠ শুনতে পেলো, ‘স্যারের হতভাগা পোষা ছাত্র’, অন্যদের মতো তোমারও মিষ্টি লাঠির ওপরে সমান অধিকার আছে। উঠে দাঁড়িয়ে, শাস্তির অস্ত্রটা নিয়ে এসে এম বার্নার্ডের চারপাশে ভেসে বেড়ানো সতেজ কোলনের সুগন্ধের মধ্যে শাস্তির অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া ছাড়া বিজয়ীর সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না।
ফলিত দর্শনের মধ্য দিয়ে পাওয়া ওই শিক্ষার মাধ্যমে মুনোজ অধ্যায়ের শেষ হয়নি। মুনোজ আরো দুদিন অনুপস্থিত থাকল এবং জ্যাক ওপরে ওপরে যতই বাহাদুরির ভাব দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে সেও কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। তৃতীয় দিনে ওপরের ক্লাসের এক ছাত্র এসে এম বার্নার্ডকে খবর দিল অধ্যক্ষ করমারি নামের ছেলেটিকে ডেকে পাঠিয়েছেন। শুধু গুরুতর কোনো ঘটনা ঘটালেই অধ্যক্ষ ডেকে পাঠাতেন। শ্রেণি শিক্ষক তার ঘন ভ্রু পল্লব তুলে শুধু বলতেন, তাড়াতাড়ি যাও। আশা করি কোনো রকম বোকামি করোনি। স্খলিত পায়ে জ্যাক ওপরের ক্লাসের ছেলেটার পিছে পিছে রওনা হলো করিডোর পেরিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো উঠোনের দিকে। করিডোরের কাগজের গাছগুলোকে ছোপ ছোপ আলো বাইরের তাপ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। করিডোরের শেষ প্রান্তে অধ্যক্ষের অফিস। অফিস রুমে ঢুকেই জ্যাক দেখতে পেল, অধ্যক্ষের ডেস্কের সামনে দাঁড়ানো নালিশ উপস্থাপনরত দুজন নারী পুরুষ মুনোজকে আগলে রেখেছেন। যদিও ফোলা এবং পুরোপুরি বন্ধ চোখের কারণে মুনোজের মুখের চেহারা বিদঘুটে দেখাচ্ছে তবু জ্যাক স্বস্তি পেল যে, সে জীবিত আছে। তবে ওই স্বস্তি উপভোগ করার মতো সময় সে মোটেও পেল না।
টাক মাথার বেঁটে এবং লালমুখো অধ্যক্ষ তার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে খুব জোরালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই একে চোখে আঘাত করেছ?
নিস্পৃহ কণ্ঠে জ্যাক বললো, হ্যাঁ।
মহিলা বললেন, আমি বলেছি না, জনাব, আমার আঁদ্রে গুণ্ডা নয়।
জ্যাক শুধু বলতে পারল, আমাদের মধ্যে মারামারি হয়েছিল।
অধ্যক্ষ বললেন, আমি এতসব জানতে চাচ্ছি না। আমি সব ধরনের মারামারি নিষেধ করে দিয়েছি। এমনকি স্কুলের বাইরেও। তুমি তোমার সহপাঠিকে মেরে যখম করে দিয়েছ। আঘাতটা তো আরো মারাত্বক হতে পারত। প্রথমবারের মতো সতর্কতামূলক শাস্তি হিসেবে তোমাকে এক সপ্তাহব্যাপী ক্লাসের সব বিরতির সময় মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এধরনের কাজ আবার করলে তোমাকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হবে। তোমার শাস্তির কথা তোমার বাবা মাকেও জানাব আমি। তুমি এখন তোমার ক্লাসে যেতে পারো। জ্যাক বজ্রাহতের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। অধ্যক্ষ ধমক ছাড়লেন, যাও বলছি!
জ্যাক কাঁদতে কাঁদতে ক্লাসে ফিরে আসার সময় এম বার্নার্ড বললেন, ঠিক আছে বাহাদুর? বলে যাও আমি শুনছি। জ্যাক প্রথমে তার শাস্তির কথা বলল; তারপর জানাল, মুনোজের বাবা মা তার নামে নালিশ করেছেন এবং সবশেষে জানাল, তাদের মারামারির কথা।
এম বার্নার্ড জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা মারামারি করেছ কেন?
মুনোজ আমাকে ‘স্যারের পোষা ছাত্র’ বলেছে।
আবারো বলেছে?
না, আর বলেনি। এখানে ক্লাসে বলেছিল।
আহা, সে তো আমি জানিই। তুমি মনে করেছ আমি তোমাকে ঠিকমতো সমর্থন দিইনি।
জ্যাক এম বার্নার্ডের দিকে অশ্রুভরা চোখে তাকিয়ে বলতে থাকল, না না। তা নয়। আসলে...। আর কিছু বলতে না পেরে জ্যাক ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
এম বার্নার্ড বললেন, যাও, বসে পড়ো।
জ্যাক অশ্রুভেজা চাহনিতে বলল, এটা ঠিক হয়নি।
এম বার্নার্ড প্রশান্ত কণ্ঠে বললেন, ঠিক হয়েছে। তুমি বুঝতে পারোনি।
পরদিন ক্লাসের বিরতির সময় জ্যাক খেলার মাঠের এক কোণায় হৈচৈরত বন্ধুদের দিকে পেছন ফিরে তার শাস্তির নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে রইল। মাঝে মাঝে শরীরের ওজন এক পা থেকে অন্য পায়ে স্থানান্তর করতে থাকল। সে সময় অন্যদের সঙ্গে খেলাধুলায় মেতে ওঠার জন্য তার মনটা ছটফট করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর পর চোরা চোখে তাকানোর চেষ্টায় সে পেছনের দিকে দেখতে পেল, এম বার্নার্ড তার অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে মাঠের কোণায় পায়চারি করছেন। তিনি জ্যাকের দিকে তাকাচ্ছেন না। দ্বিতীয় দিনে জ্যাক খেয়াল করতে পারেনি, এম বার্নার্ড কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। জ্যাকের ঘাড়ের কাছে টোকা দিয়ে তিনি বললেন, মুখ এত ভারী হয়ে আছে কেন ক্ষুদে মানব? মুনোজও মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে আমি তোমাকে ওর দিকে তাকানোর অনুমতি দিলাম। আসলেই মুনোজও মাঠের আরেক কোণায় গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এম বার্নার্ড হেসে বললেন, তোমার শাস্তি ভোগের এই পুরো এক সপ্তাহ তোমার সাঙ্গপাঙ্গরা ওর সঙ্গে খেলবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বুঝতে পারছ, তুমি একা শুধু শাস্তি পাচ্ছো না। এরকমই হওয়া উচিত। জ্যাককে আরো কিছু বলার জন্য তার দিকে আরেকটু ঝুঁকে এলেন মে বার্নার্ড। স্নেহের হাসি ছড়িয়ে বললেন, জানো তো, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় তুমি যে এত বড় একটা ঘুষি দিতে পারো তা তুমি নিজেই জানতে না মনে হয়। শুনে জ্যাকের সমস্ত হৃদয় ভালোবাসায় প্লাবিত হয়ে গেল।
আজ যিনি ক্যানারি পাখির সঙ্গে কথা বলছেন এবং চল্লিশ বছর বয়সী জ্যাককে কিডো বলছেন তার কাছ থেকে জ্যাককে এত বছরের দীর্ঘ একটা সময়, ভৌগলিক দূরত্ব এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রথমত আংশিক এবং পরে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। তার ছেলেবেলায় ১৯৪৫ সালে একদিন সৈনিকের কোট পরা একজন বয়স্ক টেরিটোরিয়াল প্যারিসে তার দরজায় কড়া নেড়েছিল বলে অল্প বয়সী জ্যাক খুশি হয়েছিল। তিনি এম বার্নার্ড, নিজেই বলেছিলেন তিনি আবারো সৈনিকের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন-যুদ্ধের জন্য নয়, হিটলারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, বৎস, তুমিও যুদ্ধ করেছ; আমি জেনেছি তুমি সঠিক ধাতুইে গড়া। তুমি তোমার মাকে ভুলে যাওনি। কেননা পৃথিবীতে মা-ই সবার সেরা। আমি আলজিয়ার্সে চলে যাচ্ছি। ওখানে আসলে আমার সঙ্গে দেখা না করে এসো না। বিগত পনেরো বছর ধরে জ্যাক তার সঙ্গে দেখা করে আসছে। প্রতিবারই বিদায় নেওয়ার আগে জ্যাক দরজার কাছে এসে গভীর আবেগে থরথর এই বুড়ো মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। বিশ্বের বুকে চলার জন্য ইনিই জ্যাককে তৈরি করে দিয়েছেন। জ্যাক যাতে আরো আরো বেশি কিছু আবিষ্কার করতে পারে সেই উদ্দেশে তিনি জ্যাকের শিকড় কেটে দেওয়ার দায়িত্ব একাই পালন করেছেন।
(চলবে...)