প্রবন্ধ /দুই বাংলার খুশির ঈদ
আজ দুই বাংলার খুশির ঈদ। একমাস নির্জলা উপবাস থাকার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বী আট থেকে আশি সকলেই এই দিনটি আনন্দ ও খুশিতে পালন করেন। খুশির কারণ, একমাস নির্জলা উপবাস থাকার পর নতুন জামা কাপড় পরে সমস্ত শ্রেণির ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ ঈদের নামাজে মিলিত হন। তারপর পরস্পরের প্রতি শুভেচ্ছা বিনিময় ও আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে তারা মেতে উঠেন। বাড়িতে বাড়িতে চলে শুভেচ্ছা বিনিময় ও নানারকম খাওয়াদাওয়া। ছেলেবেলায় আমরাও এই উৎসবে সামিল হতাম। তখন আমি অবিভক্ত বাংলার স্কুল ছাত্র। আমাদের স্কুলের মধ্যেই গ্রামের জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলেই উপস্থিত হতেন। ঈদের নামাজের পর সেখানে নানাধরণের মিস্টি বিতরণ হত। আমরা সেই মিস্টির লোভে, বিশেষ করে জিলিপি ও আমিত্তির আকর্ষণে সেখানে হাজির হতাম। মিষ্টি খেয়ে আমরা বন্ধুদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করতাম।
আমার মনে পড়ছে, ১৯৭২সালে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রথম রমজান মাস, শেষে ঈদের নামাজ দেখতে ইংল্যান্ডের সহকর্মী লুতফর রহমানের সঙ্গে বায়তুল মোকারমে গিয়েছিলাম। লুতফরের বাড়ি থেকে বের হবার সময় ও একটা টুপি দিয়ে মাথায় পরতে বলল। সেখানে গিয়ে দেখলাম, যে আনন্দ উচ্ছ্বাস আমি পুর্ব বাংলায় দেখেছি, এখানে তার যেন অভাব। স্পষ্ট শুনলাম, কেউ ফিসফিস করে বলছে, মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করে সর্বনাশ করেছে। লুতফর আমাকে বলল, তুমি এখানে দাঁড়িও না। এগিয়ে যাও। আমি নামাজ পড়ে আসছি। এরপর আমি লুতফরের বাড়িতে গেলাম, অল্প কিছু খেলাম। তারপর অফিসে ফিরে গেলাম। অনেক জায়গায় নিমন্ত্রণ ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়িতেও খেতে হল। প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান ডেকে পাঠালেন দাওয়াত রক্ষা করতে। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তখন তিনি প্রচুর খাবার দাবার পাঠিয়ে দিলেন। এছাড়া আরও নিমন্ত্রণ ছিল।
বাংলাদেশের আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সে ঘটনা অবশ্য বছর পাচেক আগের। সেটিও ছিল রমজান মাস। ঢাকা থেকে কলকাতা ফেরার পথে আমি তখন ঢাকা বিমান বন্দরে। সাথে আমার এক সহকর্মী। আমার প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে। চা খেতে ইচ্ছা করছে। যেহেতু রমজান মাস, কাউকে কিছু বলতে পারছি না। এই সময় প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক আমার কাছে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত? মুক্তিযুদ্ধের খবর করেছিলেন তো? আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি আমাকে চিনলেন কি করে? তিনি বললেন,আমি কাদের বাহিনীর লোক। আমি আপনার ওখানে গিয়েছি। বলুন, চা খাবেন? না কি কফি খাবেন? আমি বললাম, এখনতো রমজান মাস। তিনি বললেন, তা হোক। আপনি বলুন, কি খাবেন? আপনি আমার অতিথি। আমি বললাম, একটু চা হলে ভাল হত।তিনি চা এবং জলের ব্যবস্থা করলেন।
১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়, ঈদের ৭/৮দিন আগে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ফোন করে বলেন,ফ্রি আছো? এখন কি আসতে পারবে?
আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে দেখলাম তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে কয়েকজন মন্ত্রী বসে আছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানতে চাইলেন, এখানে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে? আমি বললাম,আছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম গোলক মজুমদারকে ফোন করে বললেন, আমরা ঈদের জামাত দেখতে চাই। গোলক মজুমদার বললেন, দিল্লি থেকে অনুমতি না পেলে আপনারা যেতে পারবেন না। অবশেষে দিল্লি থেকে অনুমতি নেওয়ার দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। আমি বললাম, আমায় একটি দিন সময় দিন। আমি ব্যবস্থা করছি। পরদিন অনুমতি পাওয়া গেল। কিন্তু তাজউদ্দীনকে অনুমতি দেওয়া হল না। তিনি ঘরে বসে নামাজ পড়লেন।
অন্যরা গাড়ি করে নামাজ পড়তে গেলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বললেন, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানরা বলত, এখানে নামাজ পরা হয় না। কিন্তু এসে দেখলাম, তাদের কথা ভুল।কামরুজ্জামান সাহেব বললেন, তোমরা বিশ্বাস করেছ। আমি করিনি।
প্রসঙ্গত কলকাতায় ঈদের জামাত চিরকালই ছিল। ভারতে স্বাধীনতার আগেও ছিল। কিন্তু বিগত দশ বছরে বিজেপি ধর্ম নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল। বিজেপি ও আর এস এস ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করে এবং ধর্মীয় বিভাজন শুরু করে। আর তৃণমূল নেত্রী ভোট বাড়াতে মুসলিমদের নামাজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ব্যাপারটি পছন্দ করেননি। তারা বুঝেছেন যে, এটি ভোটের খেলা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর এই ধর্ম নিয়ে খেলা পছন্দ করেন নি। দিল্লিতে দাদা এবং পশ্চিমবঙ্গে দিদি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই খেলা খেলে চলেছেন।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক