স্বাধীনতার এক টুকরো হাসি
মে মাস ১৯৭১। গ্রাম ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে। কালকেও বাড়ির ছোট ছেলেটা চট করে নিখোঁজ। তার দু'দিন আগে দাসবাবুর চাকর। এক মনে বসে ভাবে নিলু সবাই কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? আর ফিরে আসে না কেন? নিলু কিছু বুঝতে পারে না। জগৎ সংসারে তার আপন কেউ নেই বলে শহরের সবাই তার বড় আপন। কাউকে নিলু ডাকে বাবা,কাউকে মা, ভাইবোন, দিদিমা, জ্যাঠা,চাচা, মামা,খালা,পিসি- আত্মীয়ের অভাব নেই নিলুর। আর নিজের কোনো বাড়িঘর নেই বলে এই শহরের সবগুলো বাড়িঘরই নিলুর নিজের। যখন সে ইচ্ছে বাড়ি যায়। খিদে থাকলে সোজা গিয়ে ঢোকে রান্নাঘরে। ঘুম পেলে যে কোনো বিছানায় ফাঁক-ফোকর দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। নিলুকে কেউ কখনো ফেরায় না। নিলুর বয়স দশ বছর। নিলু জানে না সে হিন্দু নাকি মুসলমান। যদিও এ নিয়ে কোনো দুঃখ নেই। সুখ আছে। সে অবাধে হিন্দু ও মুসলিম বাড়িতে যায়। মাসি-পিসি খালা-ফুফু ডাকে। পেটপুরে খায়,ঘুমায়। নিলুর কোনো দুঃখ নেই। সবার নিখোঁজের বিষয়টি নিলুকে ভাবায়। মনের মধ্যে একটা গিট লেগে যায়। গিট খুলতে সে পাশের বাড়ির রতনের বাড়ি যায়। নিলু আর রতন সমবয়সী। গিয়েই দেখতে পায় রতনের ঠাকুমা।
ঠাকুমা ও ঠাকুমা সবাই কেন নিখোঁজ? সবাই কোথায় চলে গেছে?
'জানিস না দেশে গন্ডগোল লেগেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কত মিলিটারি এসেছে। মিলিটারিরা সব মানুষকে মেরে ফেলছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সব মানুষকে মেরে ফেলবে রে। ইয়া বড় বড় বন্দুক।'
নিলু শুনে খুব ভয় পায়। 'হায় হায়, তাহলে।'
'তাহলে আর কি! আমরা তো এ জন্যই চলে যাচ্ছি।'
'কোথায়?'
'কলকাতা।'
আশেপাশে খেয়াল করে দেখতে পায় নিলু খাট- পালঙ্ক ভারী জিনিসপত্র সবকিছু বাধাই করা। আরো কত কিছু।
নিলু ঠাকুমাকে আবদার করে বসে। ' ঠাকুমা আমাকে নিবেন আপনার সাথে?'
'যা, তোকে কোথায় নেব।'
তারপর ঠাকুমা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে নিলুর মাথায় হাত রাখেন। 'নিলু দাদারে, মনে খারাপ করিসনে। ওখানে আমাদেরই কোনো ঠাঁই-ঠিকানা নেই। থাকলে তোকে নিয়ে যেতাম। তারপর আবার আঁচলে চোখ মোছেন ঠাকুমা। এই দেখে নিলু সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলে।
ঠাকুমা আবারও বললো, শোন দাদা তোর ভয় নাই। তুই খুব ভালো। মিলিটারিরা তোর কিছুই করবে না। দেশ স্বাধীন হলে আবার আমরা ফিরে আসবো।
'দেশ স্বাধীন মানে?'
এবার ঠাকুমা কষ্টের মধ্যেও হাসলেন। 'এই পূর্ব বাংলা, আর পূর্ব বাংলা থাকবে না। হবে বাংলাদেশ।'
তারপর ঠাকুমা রতন সবাই নৌকা করে চলে গেল। নিলু রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকে। এবং এক সময় দেখতে পায় জনিদের বাড়িতেও সাজ সাজ রব। সবকিছু বাঁধানো। সবাই কোথায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে?
নিলু অবাক হয়ে জনির মাকে জিজ্ঞেস করে,'খালা,তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
জনির মা দুঃখী গলায় বললেন, ' ভারতে নিলু।'
'কেন'?
'ওমা তুই জানিস না,শহরে মিলিটারি এসেছে। সবাই ভয়ে চলে যাচ্ছে।
'তাই নাকি, তারা কবে এসেছে?'
'কাল সন্ধ্যায়। হাই স্কুল এ ক্যাম্প করেছে। যাকে পাবে তাকেই মারবে। তুই চলে যা কোথাও নিলু।
'এবার নিলু রেগে বললো তোমারা যাও। আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকবো।'
জনির মা বললো তুই ভালো ছেলে। দেখবি তোর কিছুই হবে না।
মন খারাপ করে খালপাড়ে একাকী হাটতে থাকে নিলু। আর ভাবে সবাই কেন চলে গেল, গ্রাম শূন্য করে। ওরা কখনো কি ফিরে আসবে?
নিলুর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই সে এখানেই থাকবে। ঠিক তখনি মিলিটারির মধ্যে একজন তার নিশানা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য খালের ওপার থেকে নিলুকে তাক করে। অটোমেটিক রাইফেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিলু দেখে একের পর এক আগুনের মৌমাছি ছুটে আসছে তার দিকে। দুই হাতে বুক চেপে ধরে নিলু। আঙ্গুলের ফাঁকে রক্তের জোয়ার বইছে। ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়ে নিলু। চোখদুটো ভীষণ টানছিল তার। তখুনি দৃশ্যটা দেখতে পায় সে। তার বুকের রক্তে তৈরি হয়েছে বিশাল একটা খাল। সেই খাল বেয়ে হাজার হাজার নৌকা ফিরছে। বাড়ির ছোট ছেলে, দাসবাবুর চাকর, ঠাকুমা, জনির মা সবাই নৌকার ভিতর। যেন আনন্দের উল্লাস। নিলু খুব খুশি। সবাই ফিরে আসছে। তাহলে এই কি স্বাধীনতা! ঠাকুমা বলেছিল।
স্বাধীনতার কথা ভেবে নিলুর ঠোঁটে বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো সুন্দর এক টুকরো হাসি ফুটেছিল। কেউ তা দেখে নি।
ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ডিএসএস/