প্রতিশ্রুতি
দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল শুভর। ও ক্লাস টেনে পড়ে। ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র সে।
এইতো ১৯৭১ সালের কথা।
বাবা ছিলেন তখনকার সরকারি চাকরিজীবী। মা গৃহিণী।
আর ছিল পরীর মতো এক ছোট বোন বন্যা।
চারজনের এই ছোট্ট সংসারে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল তাদের।
জন্মের পর থেকে অভাব নামক বস্তুর নাম শুনতে হয়নি শুভ- বন্যার । কিন্তু সে আনন্দ আর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি
কলিজার টুকরো বোনকে সবসময় আগলে রাখত শুভ। বোনের কোন ইচ্ছাই যেন অপূর্ণ রাখতে চায় না সে। তার আশা বোনের মুখের সেই হাসি যেন সে সবসময় রাখতে পারে
বন্যা ক্লাস থ্রি তে পরে । সেদিন বন্যা স্কুল থেকে ছোটে আসে দাদার কাছে। বলে
' দাদা জানিস , আমাদের স্যার বলেছে আজ থেকে নাকি স্কুল বন্ধ। ওই কী একটা পাকিস্তানী নি টাকিস্তানী নাকি আমাদের স্কুলে এসে ক্যাম্প করবে আর স্যার আমাদের বলেছে সবাইকে নিরাপদে থাকতে ।
ওরা নাকি আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে '।
বোনের মুখে এমন কথা শুনে নিয়মিত হকচকিয়ে যায় শুভ। ওদের ব্যাপারে সে আগে শুনেছে বটে , কিন্তু ওরা যে ওদের শহরে চলে আসবে এ ব্যাপারে ধারণা ছিল না তার।
ও বোনকে অভয় দিয়ে বলে
' ও তুই কিছু চিন্তা করিস না বোন। আমি আছি না '।
ওরা কথা বলতে বলতে কেউ দরজায় কড়া নাড়ে।
দরজা খুলে দেখতে পায় বাবা ,আর হাতে মস্ত বড় ইলিশ মাছ।
ইলিশ মাছ দেখেই বন্যা মস্ত খুশি । ইলিশ তার প্রিয় মাছ ।
' রাতে বেশ ভালো ভোজ হবে,বল দাদা
হ্যা ,তা তো হবেই, তবে মা কে বলে বড় পিসটা কিন্তু আমিই নেব
হুঁহুঁ , ও আমি হতে দিচ্ছি না বলে রাগ দেখিয়ে এখান থেকে চলে যায় বন্যা '
বোনকে মাঝে মাঝে এমনভাবে রাগাতে ভালো লাগে শুভর।
রাত ৮ টা,
হঠাৎ বাবার ডাক পড়ল
' শুভ - বন্যা এদিকে এসো আর হ্যা বন্যার মা তুমিও শোন ,
আজ থেকে আমার অফিস বন্ধ দিয়ে দিয়েছে আর শুভ -বন্যার স্কুল ও তো বন্ধ দিয়েছে, দেওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না ,দেশের যা পরিস্থিতি,
তা শোন তোমাদের সবাইকে নিয়ে আমি কাল আমার এক গ্ৰামের এক বন্ধুর বাড়িতে চলে যাব, এদিকের পরিস্থিতি টা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরছি না
তোমরা জামাকাপড় গুছিয়ে রেখো''
স্বামীর মুখে এসব কথা শুনে নিয়মিত হকচকিয়ে যান শুভর মা । তার এই সুন্দর করে সাজানো গোছানো সংসার ছেড়ে চলে যেতে হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য এটা ভেবে সামান্য কষ্টও পান তিনি।
রাত ১০ টা
মা ডাক দিলেন সবাই খেতে এসো
শুভ -বন্যা ও তাদের বাবা খেতে এলেন ,
মা বন্যার প্রিয় খাবার সরষে ইলিশ রেঁধেছেন।
মা ভাত খেতে দিলেন , হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হলো
' কই আন্দার হে কেয়া'
বাবা গিয়ে দরজা খুললেন।
দরজা খুলা মাত্রই ৫ জন লোক ঘরে ঢুকল।
'একি, এদের মাথায় টুপি, বুট জুতা, কাঁধে বন্দুক,
ঠিক মিলে যাচ্ছে স্যারের কথামতো,
-ভাবছে বন্যা ''
শুভও দাঁড়িয়ে আছে বন্যার পাশে
হঠাৎ ঠাস ঠাস করে দুটো আওয়াজ হলো লুটিয়ে পড়েন বাবা , আরও দুটি শব্দে মা ও পড়ে যান ,
সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে শুভর কাছে ,
' এ আবার কি, নিশ্চয় আমি স্বপ্ন দেখছি'
হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠেন মা ,
শুভ দেখল ঘরের মেঝে রক্তে ভরে গেছে
এতক্ষণ পর ওর বোনের কথা মনে হয়, বন্যা কোথায়
দেখে বন্যাকে ওরা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
বন্যা চিৎকার করছে দাদা দাদা বলে ,,
শুভ কিছু বোঝাতে পারছে না কিন্তু যখন বোঝাতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে
আজ ২০২৩ সাল ,২৬ শে মার্চ
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যায় শুভর, মনে পরে ১৯৭১ এর কথা
আজ শুভ এই সমাজের একজন বিত্তশালী ব্যক্তি সাথে ৬৫ বছরের বুড়োও।
গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা সব আছে নেই শুধু প্রানপ্রিয় সে বোনটি । আজও শুভকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে বোনকে দেওয়া সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি
' ও তুই কিছু চিন্তা করিস না বোন। আমি আছি না '
ডিএসএস/