না দেখে যাওয়া স্বাধীনতা
সময়টা মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের। বাইরে দুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থামার কোনো নামই নেই এদিকে দেশে মিলিটারি ঢুকছে নাকি। আলাদাতপুর গ্রামের মাতব্বর মুজাহিদ মোড়ল বললো ওরা নাকি সব মানুষকে মেরে ফেলবে। কিছু মানুষ তো সেই ভয়ে বিভিন্ন জায়গাই পালায় যাচ্ছে।
মাতব্বর বললো ভারতেও নাকি পালায় যাচ্ছে। আবার গোপনে তাকি মাতব্বর খবর পাইছে কিছু মানুষ ভারতে যাচ্ছে নাকি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে। এই সব কথা বাড়িতে এসে বললো রইজ খানের ৬ বছরের ছেলে আশরাফুল। এই সব শুনে ঘরের বাইরে থেকে ছুটে আসলো আশরাফুলের মা আলেয়া বেগম। আলেয়া বেগম অনেক সাহসী একজন মহিলা। কোনো কিছুতেই তেমন ভয় পাই না। আলেয়া বেগম জিজ্ঞাসা করলো হ্যারে আশরাফুল এই সব কথা মাতব্বর কোথায় বলতেছিলোরে???
তখন আশরাফুল বললো মা এই সব কথা তো চৌরাস্তার মোড়ে বসে বলতেছিলো মাতব্বর। খাটের উপর বসে থাকা রইজ খান জিজ্ঞাসা করলো মিলিটারি দেশে এসেছে বলে কি তুমি ভয় পাচ্ছো আলেয়া?? আলেয়া বেগম বললো না আশরাফুলের বাপ। শুনে অনেক খুশি হলো রইজ খান। তার পরের দিনই ছিলো রইজ খানের ভারতে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে কথা আলেয়া বেগম ছাড়া গ্রামের আর কেউ জানে না। কিছুক্ষণ পরে আশরাফুল বাইরে খেলতে চলে গেলো আর এদিকে আলেয়া বেগম রইজ খানের প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য জামাকাপড় এবং বাকি সব কিছু একটি কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো। রাতে পেরোতেই ভোরের দিকে বেরিয়ে পড়লো রইজ খান। দীর্ঘ অনেক দিন যাবত প্রশিক্ষণ নিলো। এর মধ্যেই দেশে শুরু হলো বিশাল মুক্তিযুদ্ধ।
পাকিস্তানি মিলিটারি যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে হত্যা করছে। এই সব দেখে আশরাফুল সব সময় ভয় পেতো। কিন্তু আলেয়া বেগম আর ভয় পেত না। দীর্ঘ অনেক দিন পর যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রইজ খান একদিন বাড়িতে আসে ( মাথায় গামছা বাধা, পরনে লাল লুঙ্গি, কাধে রাইফেল ) তাকে দেখে আশরাফুল তো বেজাই খুশি তার বাপ বাড়িতে এসেছে। কিন্তু বাপের কাধে রাইফেল দেখে একটু ভয় পাই আশরাফুল। রইজ খান এসেই আলেয়া বেগমের কাছে ভাত চাই এবং বলে গত চারদিন যাবত কিছুই খাইনি কিছু খেতে দাও। তখন আলেয়া বেগম খাবার দেয়। খাবার খেয়ে যাওয়ার সময় রইজ খান কিছু খাবার গামছাই বেধে নিয়ে যাই আর বলে আমার সঙ্গের ভাইদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি। তখন আলেয়া বেগম জানতে চাই তারা এখন কোথায় যুদ্ধ করছে রইজ খানের কাছে।
রইজ খান বলে আমরা মুচিরপোল বাজারের কাছে একটি ছোট ক্যাম্প করেছি সেখানেই থাকছি আর একেক সময় একেক জায়গাই যাচ্ছি। তখন একটু দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আলেয়া বেগম বলে কাল থেকে আমি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে যাবো ক্যাম্পে এবং আরো যা যা লাগে সব কিছুই নিয়ে যাবো। এ কথা শুনে রইজ খান বলে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। পাকিস্তানি মিলিটারি যদি জানতে পারে তাহলে তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে। একথা বলে আর একটু সময় ও দেরি করে না রইজ খান চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। কিন্তু আলেয়া বেগম রইজ খানের কথা না শুনে পরের দিনই খাবার গামছায় বেধে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখার খুব ইচ্ছা যে আলেয়া বেগমের। তিনি প্রাণের মায়া না করে নিয়মিতই খাবার নিয়ে যেতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। এভাবেই কেটে যায় অনেক দিন। মুক্তিযোদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল স্বাধীন হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ একদিন খাবার দিতে যাওয়ার আগে আশরাফুলকে আলেয়া বেগম ডেকে বলেন বাপ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিতে যাচ্ছি হয়তো আর কিছু দিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবে আর আমার ইচ্ছাও পৃরণ হবে। দেশ স্বাধীন হওয়া দেখতে পারবো। একথা বলে ঘর থেকে খাবার নিয়ে বেরিয়ে যায় আলেয়া বেগম খাবার ঠিক মতো পৌছেও দেয় মুক্তিযোদ্ধারা ও রইজ খান বলে হয়তো কাল বা পরশুই আমাদের এই অঞ্চল স্বাধীন করতে পারবো। এ কথা শুনে খুব খুশি হয় আলেয়া বেগম। আর হবেই বা না কেন তার অনেক দিনের ইচ্ছা সে স্বাধীনতা দেখবে। মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া শেষ হলে আলেয়া বেগম বাড়িতে ফেরার জন্য রওনা হয়। কিন্তু সেদিনই পাকিস্তানি বাহিনী টার্মিনাল এলাকা থেকে শুরু করে রূপগঞ্জ বাজার পযর্ন্ত এলোপাথাড়ি গুলি চালাই আর সেই গুলিতেই মৃত্যু হয় আলেয়া বেগমের। ঠিক তার কিছু দিন পরেই দেশ স্বাধীন হয়। মুক্তিযোদ্ধা রইজ খানও বাড়ি ফিরে আসে দেশকে স্বাধীন করে। কিন্তু যার এক মাত্র ইচ্ছা ছিল দেশকে স্বাধীন দেখার সেই আলেয়া বেগমই দেশকে স্বাধীন দেখে যেতে পারলো না।
ডিএসএস/