মুক্তিযোদ্ধা মতিন মিয়া রিপোর্টিং
বাকসিঁড়ি গ্রামের সবচেয়ে ব্যস্ততম জায়গা, শাহিন মিয়ার চা'য়ের দোকানে বসে আছে বেশ কিছু মুরুব্বি। আর দশটা চা'য়ের দোকানের মতো এখানেও চলছে যুদ্ধ নিয়ে তুমুল আলোচনা।
ধোঁয়া ওঠা চা'য়ে চুমুক দিতে দিতে রেডিওতে শোনা খবর নিয়ে দুঃচিন্তা করাটা তাদের নিত্যদিনের কাজ।
তবে আজকের খবরটা শুনে থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে দোকানে, হঠাৎ করেই চা যেন পানসে হয়ে গেছে।
যে যার যার মতো কাপ রেখে, চিন্তিত মুখে বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছে।
বাসায় পৌঁছে আবুল মিয়া হাঁক ছাড়লেন, 'মতিনের মা, এই মতিনের মা, কই গেলা? দ্যাশটা রাখ হইয়া যাইতাছে আর হেই বেডির পাত্তা নাই, মরলা নাহি মিলিটারী আওনের আগেই।'
'আইতাছি তো, আওনের সময়ই দিবেন না? আপনে তো চান যে আমি মইরা যাই, আমি মরলেই তো আপনে খুশি হইবেন। ঘরে নতুন বউ তুলবেন, আমি কি বুঝি না ভাবছেন, জ্যাতা অবস্থায় মাইরা ফালাইতেছেন আমারে।' বলতে বলতে কাখে পানি ভর্তি কলসি নিয়ে আঙ্গিনায় প্রবেশ করলেন মতিনের মা।
ঘটনা জানোনি? মিলিটারীরা আমাগো তিন গেরাম পরে আইসা ঘাটি বাঁনছে শুনলাম। কবে যে আমাগো গেরামে আইসা পরে, রাইত বিরাইতে বাইর হওয়া যাইবো না, মতিনরে কইয়া দিও।
' কী কইবো আমারে, আব্বা? তুমিই কইয়া দাও, কি এমন কতা' বলতে বলতে মতিন বাড়িতে ঢুকলো।
'গেরামে মিলিটারি আইতাছে বাজান, তুই বাইর হইস না, জোয়ান পোলাগো নাকি ধইরা বাইন্ধা নিয়া যাইতাছে।' কান্নার স্বরে বলল মতিনের মা।
'ধ্যাত্তেরি, কতায় কতায় কান্দো ক্যা? মিলিটারী আইছে, ওগো দেখায়া দিমু আমরা কি জিনিস, সালারা কি পাইছে? আমগো কি মানুষ মনে হয় না? রেডিওতে তো শুনতেছি আমাগো মানুষ পিছায়া নাই, ঢাকায় নাকি যুদ্ধ লাইগা গেছে, বড় বড় শহরেও মিলিটারীগোরে শিক্ষা দিতাছে। আসুক এই গেরামে, তহন বুঝামু বাঙালী কি জিনিস।"
মতিনের কথায় নাখোশ আবুল মিয়া, রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন এবং চেঁচিয়ে বললেন, মাতব্বরি করার দরকার নাই, বাঁইচা থাকা লাগবো। জীবন না থাকলে দ্যাশ দিয়া কি করবি হারামজাদা? যাগোর, বাঁচার শখ নাই, ওরা যাইয়া মরুক, তুই এক পা বাইরে ফালাবি না, আমার হাতে খুন হবি।
বাবার কথায় মতিন জবাব না দিয়ে ঘরে চলে গেলো, কারণ সে জানে এখন জবাব দিলে বিপরীত কিছু হবে। তাকে আগামী দু'দিন সাবধানে থাকতে হবে।
এতোক্ষণ মতিন ও গ্রামের কয়েকজন ছেলে শাহিন মিয়ার বন্ধ চা'য়ের দোকানে ছিলো, বাইরে থেকে বন্ধ দেখা গেলেও ভিতরে তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা চলছিলো।
এই গ্রামের দু'জন ছেলে শাকিল ও রঞ্জু লেখাপড়ার সুবাদে ঢাকায় থাকতো যারা মিলিটারীর কথা শুনে চুপিচুপি গ্রামে এসেছে এবং গ্রামের অন্য যুবকদের নিয়ে পরিকল্পনা করছে মিলিটারীদের থামানোর।
টানা দু'দিন পরিকল্পনার পর শাকিল আর রঞ্জু দু'টি ছোট দল করে রাতের আঁধারে বেড়িয়ে পরে পরশপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে।
আসার আগে মতিন তার বাবার বালিশের পাশে একটা চিরকুট রেখে আসে, তার বাড়ি ছাড়ার কথা জানিয়ে।
কয়েক মাস পরে রেডিওতে বিজয়ের উল্লাস শোনা যায়, সব জায়গায় দেখা যায় লাল সবুজের পতাকা।
বাকসিঁড়ি গ্রামের দুয়েকজন ফিরে এসেছে, রঞ্জুর লাশটা তারা অচেনা কোনো গ্রামেই দাফন করে দিয়েছে।
শাহিন মিয়াকে মিলিটারীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, হয়তো তার লাশটা কোনো বধ্যভূমিতে শায়িত আছে। শাকিলের লাশ নদীতে ভেসে গেছে তাদের চোখের সামনে, তারা কিছুই করতে পারেনি।
মতিন মিয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি, একটা সময় সে দল থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিলো। তবে তার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
তবে একজন উন্মাদকে দেখা যায় বিভিন্ন বধ্যভূমিতে পরে থাকতে, সেখানে শায়িত মানুষগুলোকে বিজয়ের জানান দিতে। তাদের রক্ত যে বিফলে যায়নি সে সংবাদ দিতে এই উন্মাদ পৌঁছে যায় বিভিন্ন শহরের বধ্যভূমিতে।
তার মুখে একটাই কথা শোনা যায়, " মুক্তিযোদ্ধা মতিন মিয়া রিপোর্টিং, দ্যাশ স্বাধীন হইছে, আর ভয় নাই আমাগো।"
কালীবাড়ি, ঠাকুরগাঁও।
ডিএসএস/