সেই ছেলেটি
১৯৭১ সাল। চট্টগ্রামের পাহাড়তুলি গ্রামের শিশু রাজ। তার মা রোকশানা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করেন, বাবা রহমত আলি একজন সামান্য দিনমুজুর। তার ছোট বোন রহিমা প্রথম শ্রেনীতে পড়ে। রাজ পড়ে নবম শ্রেনীতে।হঠাৎ একদিন তাদের গ্রামের দিকে কারা যেন গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছিলো। তাদের গুলির প্রথম স্বীকার হলো রাজের বাবা রহমত আলি। মাঠ থেকে ফেরার পথে গুলির আঘাতে নদীর ধারে মুখন থুবড়ে পড়ে গেল। তার মা রোকশানা বেগম এইক খবর পেয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন কিন্তু পৌছাতে পারলেন না। একটা গুলি এসে লাগলো তার বুকে।মৃত্যুবরণ করলেন তিনি।
বাবা মাকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়লো রাজা। কিন্তু তার বাবা -মাকে কে বা কারা মারলো কিছুই বুঝতে পারলোনা সে। পরেরদিন তার বাবার বন্ধু আবুল চাচাকে জিজ্ঞেস করলো তার বাবা-মাকে করা বা কেন মারল। চাচা বললেন গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি এসেছে। তারা আমাদেরকে স্বাধীনতা দিতে চাই তাদের বিরুদ্ধে আমরা মাঠে নেমেছি বলে তারা আমাদের ওপর অত্যাচার করছে।যুদ্ধ করতে হবে, দেশকে দস্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। রাজ অবাক হয়ে বলল যুদ্ধ কি চাচা। আবুল হোসেন বলেন যুদ্ধ হচ্ছে লড়াই। পাকিস্তানিরা আমাদের স্বাধীন হতে দিতে চাই না। তারা আমাদের শোষণ করতে চাই। এই বলে চলে গেলেন আবুল হোসেন। রাজ বাবা মাকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়লেও তার মনে জেগে উঠলো এক নতুন স্বপ্ন।। সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ দেখলো গ্রামের লোকজন জিনিসপত্র নিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে। সে তার সামিয়া পিসি কে বললো তারা কোথায় যাচ্ছে। পিসি বলল "গ্রামে মিলিটারি এসেছে সবাইকে অনেক মারধোর করেছে তাই গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তোরা আমার সঙ্গে চল।"সামিয়া পিসির ছেলে মেয়ে নেই। রাজের মা তার বাড়িতে কাজ করতো তখন থেকেই তাদের ভাই -বোনকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। রাজ হেসে বলল আমি যাব না। দেশের জন্য যুদ্ধ করবো।
পিসি তার ওপর রেগে বলল শোনো ছেলের কথা এইটুকু ছেলে তুই আবার কিসের যুদ্ধ করবি। গ্রামের সবাই চলে যাচ্ছে আর তুই কি-না যুদ্ধ করবি। চল আমার সাথে কিন্তু রাজ বললো না আমি যাবোনা। রাজ কে কিছুতেই নিয়ে যেতে না পেরে পিসি রহিমা কে নিয়ে চলে গেলো। সেইদিন রাতে রাজ তার বন্ধু রবিন,সিয়াম,রাহাত সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে বলে রাজি করলো। রাহাতদের বাড়ির রেডিও দিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলো,"এইটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।" সকালে তারা মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার শফিকুদ্দিনের সাথে দেখা করে বলল আমরাও যুদ্ধ করবো।কমান্ডার তাদের মানসিকতা দেখে খুশি হলেন।তাদের কে অস্ত্র দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু রাজ যুদ্ধ করবে অস্ত্র চালানো শিখবে এইসব ভেবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই কমান্ডার পাশের গ্রামে যেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলছিলো তাদেরকে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। রাজ খুব সহজেই অস্ত্র চালানো শিখে গেল। কমান্ডার প্রধান অনেক খুশি হলেন।
১১মে সে ১০জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে যুদ্ধে নেমে পড়ে। সেইদিন রাজ অনেক সাহসিকতার পরিচয় দেখায় শফিকুদ্দিন তাকে কিশোরদেরর ক্যাপ্টেন বানালেন।পরের দিন, ১৫ জন একসাথে মিলে বের হলো যুদ্ধে। তারা একটা গোপন স্থান তৈরি করেছিল। যেখানে ওপরে ছিলো কাঠের পাটাতন এবং মাটির নিচে ঘরের মতো গর্ত। তার সামনে ছিলো উঁচু বন। প্রায় এক হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তনিরা হাজির হলো রাজ পিছন থেকে গুলি ছুড়তে থাকে। তারা কয়েকজন করে চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রচন্ড গুলির আঘাতে অনেকে নিহত হয় কিন্তু তাদের গুপ্ত স্থান বুঝতে না পারায় চারদিকে গুলি ছুড়তে শুরু করলো। পাকিস্তানিদের তুলনায় তারা অনেক কম থাকায় চারদিকের গুলির তোড় সহ্য করতে না পেরে অনেকেই নিরাপদ স্থানের দিকে চলে গেলো।
রাজকেও সবাই যেতে বললো কিন্তু সে যেতে রাজি হলো না। অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলো। কিন্তু শত শত অস্ত্রকে একটা অস্ত্র দিয়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব না। এইটা বুঝেও পিছু সরে যাই নি সে। কিছুক্ষণ পর একটা গ্রেনেড এসে লাগলো তার বুকে। মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে। কাঠের পাটাতনের মুখ খোলা ছিলো গড়িয়ে পড়লো গর্তে। তার বন্ধুরা তাকে ধরাধরি করে সরিয়ে নিয়ে গেলো। ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছিলো। মৃত্যুশয্যায় তার মুখ দিয়ে একটি শব্দ ভেসে আসছিলো বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন নিয়ে ঝরে গেলো একটা প্রাণ। পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিলো সেই ছেলেটি।
নিউ গভঃ ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী
ডিএসএস/