অগ্নিঝরা একাত্তরের দিনগুলি
১৯৭১ সাল। মাসটা ছিল মার্চ। তখন অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। যে কোন সময় যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। মানুষের মনে আতংক । পাকিস্তান সৈন্য এনে মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। কাজ কর্ম থেকে মানুষ বিরত থেকে নিরাপত্তার জন্য বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে।
কি যেন এক জরুরী কাজে আমি সেদিন গিয়েছিলাম আলমডাঙ্গাতে। কাজ হয়নি। ষ্টেশনে ফিরে আসি। ষ্টেশন ফাঁকা। কি যেন এক আতংক বিরাজ করছে। দোকান পাট সব ব্ন্ধ। ট্রেন এসে থামলো আলমডাঙ্গা ষ্টেশনে। বেলা ১১/১২ টার সময়। তারিখটা ছিল সম্ভবত ৮ই মার্চ। ট্রেন যখন চুয়াডাঙ্গা ষ্টেশনে এসে থামে তখন মানুষের মধ্যে ছুটাছুটি করার যেন প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। কি ব্যাপার জিজ্ঞাসা করতেই একজন বলে বাঁচতে যদি চাও পালাও। বড় বাজারে পাকিস্তানের সৈন্য এসে গেছে। যাকে পাচ্ছে তাকে গুলি করছে।
মনটা খারাপ হয়ে যায়। কি করে বাড়ি যাবো। অন্য দশ জনের মত আমিও ছুটতে থাকি। ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে যায়। এ গলি ও গলি দিয়ে হাটতে হাটতে এক সময় বাড়িতে পৌছে যায়। বাড়ির সকলে আমার জন্য পথ চেয়ে আছে। সৈন্য আসেনি। দেশে আগুন ধরেছে । ব্ঙ্গবন্ধুুর ভাষণ প্রচারিত হচ্ছে। মানুষ রেডিও ঘিরে ভাষণ শুনছে। -----------আর যদি একটা গুলি চলে আমার মানুষকে হ্ত্যা করা হয়। "
ভাষণ শেষ হতেই সবাই যেন ঘাম মুছতে থাকে। তাহলে দেশে কিছু একটা হচ্ছে। পাকিস্তানের নির্যাতন ও শোষণের হাত থেকে এবার বাঙালিরা মুক্তি পাবে। ২৩ বছরের আন্দোলন ও লড়াইয়ের ফসল এবার অর্জিত হবে। ঘরে ঘরে বীর বাঙালিরা জেগেছে। তখন আমি লেখালেখি না করলেও মনের আবেগে একটি গণমুখী ছড়া লিখেছিলাম "বাঙালিরা জাগলো এবার
শকুনেরা বুঝবে,
দিশেহারা হয়ে ওরা
পালাবার পথ খুঁজবে। "
এরপর যা হবার তা তো হল। নির্বিচারে ও বিনা উস্কাানিতে পাকিস্তানের জঙ্গী বাহিনীরা ২৭মার্চ কালো রাতে রাজার বাগ ঘুমন্ত পুলিশের উপর গুলিবর্ষণ করে। বহু পুলিশ সেদিন শহিদ ও আহত হয়। বাঙালিরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল তারা আর চুপ থাকতে পারে না। তারা মুক্তিযোদ্ধায় নাম লেখায় এবং প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে আশ্রয় নেয়।
তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা মহকুমার আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়। মতিবাবুর পরিত্যাক্ত ভবনে সচিবালয় গঠন করা হয়। সচিবালয়ের যাবতীয় কার্যাদী পরিচালনার জন্য দক্ষিন পশ্চিম রনাঙ্গনের মনোগ্রামযুক্ত সিল প্রয়োজন হলে বাবু এন এন সাহা প্রনয়ন করেন। পরবর্তীতে সামান্য পরি- বর্তন করে বাবু এন এন সাহা রা্ষ্ট্রীয় মনোগ্রামও প্রনয়ন করেন। যা আজও রাষ্ট্রীয় কার্য্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।
৩ রা এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানি বিমান চুয়াডা্ঙ্গার উপর অবিরাম বোমা বর্ষণ করে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিসেনারা অস্ত্র ধরে। শুরু হয় যুদ্ধ । সাধারণ মানুষ প্রানের ভয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। যুদ্ধের এ সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়, আহত হয় এবং মা বোনেরা সম্ভ্রমহানি হয়।
শুধু কি তাই ঘর বাড়ি অফিস আদালত দোকান পাট সব আগুন দিয়ে জালিয়ে ধবংস করে পাক বাহিনীরা । ঐ সময় ভারতে অবস্থান কালে আমরা অমানষিক কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করি। তবু দেশের প্রতি ভালবাসা তিল মাত্র কম ছিল না। মা চরম অসুখে পরে। অপর দিকে বাবা দেশে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরে। অবশেষে দেশে ফিরে আসি। এসে যা দেখলাম তা বিভৎস দৃশ্য। মা বাবা কাঁন্নায় ভেঙে পরে। বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল লুঠ করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কিছুই পাইনি। যারা দেখেছে তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে। একাত্তরের সেই দুর্বিসহ দিনগুলো আজও ভুলিনি। প্রতিটি মুহুর্ত্ত কুরে কুরে খায় আমাদের বিদগ্ধ হৃদয়টাকে। দুঃখটাকে বুঝাবার কোন হৃদয়বান ব্যক্তিকে পাইনি।
স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবস
যখনই দেশে আসে,
সেদিনের সেই যন্ত্রণাটা
চোখের পাতায় ভাসে।
সেই থেকে আজও দুখটাকে বহন করে বেড়াচ্ছি। বুকের ভেতরে আজও ভয়াবহ ভাবে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। মা
বাবা কেহ আজ বেঁচে নেই। না ফেরার দেশে চলে গেছে। সেখান থেকে হয়তো বাবা মা আশির্বাদ করছে। সমস্ত দুঃখ কষ্টকে ভুলে আসুন সবাই কন্ঠ মিলায়-
আসুন সবাই এদেশটাকে
আমরা গড়ে তুলি,
হিংসা বিদ্বেষ হানাহানি
সব কিছু আজ ভুলি।
ডিএসএস/